সালথা প্রতিনিধিঃ
ফরিদপুরে হত্যা মামলাকে পুঁজি করে মিলেমিশে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। জেলার সালথায় তরুণীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় কাসেম ব্যাপারী (২৮) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাকে পুঁজি করে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। দাবিকৃত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে চলছে বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুর লুটপাট। করা হচ্ছে হত্যা মামলার আসামি।
এলাকা সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার সালথা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ মাতুব্বরকে প্রধান করে মামলা দায়ের করেন নিহত কাসেম বেপারীর পিতা মধ্যবালিয়া গ্রামের পান্নু বেপারী। এতে গট্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু জাফর মোল্যাসহ ২৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সালথা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার খায়রুল বাসার আজাদ ও তার ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ মাতুব্বর, সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার নুরু মাতুব্বর, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রফিক মাতুব্বর, গ্রাম্য মোড়ল হিরু মোল্যা, হাসান বেপারীসহ কয়েকজন ব্যক্তি বিএনপির নাম ভাঙিয়ে এসব চাঁদাবাজি করেছে।
অভিযোগ উঠেছে- হত্যা মামলা থেকে বাঁচাতে, হুমকি-ধমকি, লুটপাট, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে যে চাঁদাবাজি করা হয়; তাদের মধ্যে উপজেলার জয়ঝাপ গ্রামের মুসা তালুকদারের কাছে থেকে ১৩ লাখ, বালিয়ার সাহজাহান মাতুব্বরের কাছে থেকে ৩ লাখ, সবুর খাঁর কাছে থেকে ৫০ হাজার, হাফিজুর মাতুব্বরের কাছে থেকে ২ লাখ, ওমর মাতুব্বরের কাছে থেকে ১ লাখসহ বালিয়া, পাটপাশা, গট্টি, জয়ঝাপসহ আশপাশের বিভিন্ন লোকজনের কাছে থেকে ভয় দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। লুটপাট করা হয়েছে অন্তত ৫-৭টা বাড়িঘর। দিনদুপুরে লুট করা হয়েছে ৪টি গরু। এলাকায় বিএনপি নাম ভাঙানো ওই নেতাদের ভয়ে কেউ ‘টু’ শব্দ করতে পারছে না। এছাড়া থানা পুলিশকেও এরা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাপ সৃষ্টি করে নিরীহ মানুষকে যাতে আসামি করা হয় সে ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।
মামলার আসামী ওয়াদুদ মাতুব্বর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আমি এলাকাছাড়া। আর হত্যার ঘটনা ঘটেছে জয়ঝাপ গ্রামে। অথচ আমাদের গট্টি ও বালিয়া গ্রামের অনেক লোককে আসামি করা হয়েছে। আমাদের হয়রানি করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলা দেওয়া হয়েছে। আমরা আইনিভাবে মামলা মোকাবেলা করব।
সালথা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল ইসলাম বলেন, গত ১৬ অক্টোবর বুধবার রাত ১০টার দিকে ফরিদপুর থেকে আসার পথে বালিয়া বাজারে আসলে ৪০-৫০ জন মুখোশ পরা লোক দেখি ৪টি গরু নিয়ে যাচ্ছে, আমি সেটা আমার মোবাইলে ভিডিও করলে চার-পাঁচজন যুবক আমার গলায় রামদা, ছুরি ও চাকু ঠেকিয়ে আমার মোবাইল ছিনতাই করে নিয়ে যায়, পরবর্তীতে সালথা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার খায়রুল বাসার আজাদ ও তার ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ মাতুব্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমার ফোন ফেরত দিয়ে যান।
তবে, এসব অপকর্ম ঢাকতে শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে ফরিদপুর সালথা উপজেলার বালিয়াগট্টি বাজারে বিএনপির সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সালথা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার খায়রুল বাসার আজাদ।
সংবাদ সম্মেলনে সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানসহ বিএনপির বেশ কিছু পদধারী নেতাদের উপস্থিতিতে এ সময় গট্টি ইউনিয়ন আ’লীগের সহ-সভাপতি বজলু মাতুব্বর, সালথা উপজেলা আ’লীগের সদস্য ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার নুরু মাতুব্বর, সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফজলুল মতিন বাদশা মিয়ার ভাতিজা ও আওয়ামী লীগের কর্মী কামরুল ইসলাম মজনু, সালথা উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সহ-সভাপতি মুনসুর মাতুব্বর, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রফিক মাতুব্বরসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় সালথা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার খায়রুল বাসার আজাদ হত্যা মামলাকে পুঁজি করে তার বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজি, বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুর লুটপাট, চাঁদার টাকা না পাওয়ায় কাউকে কাউকে মামলার আসামি করা, এলাকায় গ্রাম্য দল ভারির রাজনীতি করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা যে সংবাদ সম্মেলন করেছি, সেখানে সবাই বিএনপির নেতাকর্মী ছিলেন। সেখানে কোনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিল না। এটা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
সালথা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার খায়রুল বাসার আজাদ ও তার ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ মাতুব্বর হত্যা মামলাকে পুঁজি করে এসব চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যাদের নাম বলা হচ্ছে তারা তার পূর্বের শত্রু ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের কাছে থেকে চাঁদা দাবির বিষয়টি একদম ঠিক নয়।
এ ব্যাপারে সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হত্যা মামলাকে পুঁজি করে চাঁদাবাজির বিষয়টি আমার জানা নেই। এটা দলের ভাবমূর্তি চরম ক্ষুন্ন হয়। আমি খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখবো।
তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপির নেতার সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমি তো সবাইকে চিনি না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিল কি-না জানা নেই। তবে অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিএনপির সঙ্গে যোগ দিচ্ছে বলে শুনেছেন বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব একে কিবরিয়া স্বপন বলেন, হামলা, দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা। এছাড়া এ সংক্রান্ত কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ দিলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা-সার্কেল) মো. আসাদুজ্জামান শাকিল বলেন, কাসেম বেপারী নামের এক যুবককে হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় যাতে কোনো নিরীহ লোক হয়রানির শিকার না হয় সেটা পুলিশ তদন্ত করে দেখবে।
তিনি বলেন, ওই যুবক নিহত হওয়ার পর থেকে বালিয়া এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এলাকার পরিবেশ শান্ত রাখতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তৎপর রয়েছে।
নিহতের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে কাশেম ব্যাপারী ও মিলন জয়ঝাপের ইমাম বাড়ি মেলা ও নৌকা বাইচ দেখতে যান। তাদের সাথে এক তরুণীও ছিল। মেলার ভেতরে কেনাকাটার সময় কাসেম ও মিলনের সাথে থাকা তরুণীকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন স্থানীয় জয়ঝাপ গ্রামের মুসা মোল্যার মাদকাসক্ত ছেলে বাহাদুর মোল্যা এ সময় কাসেম ও মিলন প্রতিবাদ করলে বাহাদুর ক্ষিপ্ত হয়ে তার ছোট দুই ভাইকে ডেকে আনে। পরে বাহাদুর (২৩) ও তার ভাই তৈয়াব (২০) এবং সোহেলসহ (১৮) কয়েকজন তরুণ চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কাসেম ও মিলনকে কুপিয়ে জখম করে। স্থানীয়রা আহত দুই জনকে উদ্ধার করে ফরিদপুরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা কাসেমকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর আহত মিলনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তিনি ওই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।