বাংলার আকাশ ডেস্কঃ
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উড়োজাহাজ ক্রয়ের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ১০৯ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে বিমানের। ২টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, ১টি ইঞ্জিন ও ১টি স্পেয়ার্স পার্টস কেনায় এই বাড়তি টাকা ব্যয় হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের রিপোর্ট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
চুক্তি অনুযায়ী বিনিময় হার এবং সুদের হার যখন যা থাকবে, সেই অনুযায়ী বিমানকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগে যেখানে লাইবর (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেট) রেট ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৬৫ শতাংশ। ফলে ঋণের ক্ষেত্রে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হবে। এ খাতেও বিমানকে বিপুল অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হবে।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও অতিরিক্ত সচিব যাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে কত টাকা দিতে হবে তার হিসাবনিকাশ করছি। পরিস্থিতি যাই হোক, আমরা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোনো বকেয়া নেই।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে লাগামহীন গতিতে বাড়ছে ডলারের দাম। আর দাম বাড়ায় অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে সব ধরনের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অর্থের পরিমাণ। ১১ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানকে দেওয়া এক চিঠিতে সোনালী ব্যাংক জানিয়েছে, ডলারের দাম বাড়ায় বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বাবদ তাদেরকে ১০৯ কোটি টাকার বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিমান থেকে বাড়তি এই টাকা না পাওয়ায় সোনালী ব্যাংক চিঠিতে এই টাকা দাবি করে। চিঠিতে সোনালী ব্যাংক আরও জানিয়েছে, আগামী দিনে ঋণের আরও যেসব কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, ডলারের দাম বাড়ায় সেগুলোয়ও বেশি অর্থ দিতে হবে। ডলারের সঙ্গে সুদের হার বাড়লে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হারও বাড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দেওয়া চিঠিতে সোনালী ব্যাংক ঋণের সার্বিক চিত্র এবং ডলারের দামের কারণে বাড়তি অর্থ পরিশোধের চিত্র তুলে ধরেছে। চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোয় দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডকে ২টি বোয়িং উড়োজাহাজ ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, একটি স্পেয়ার ইঞ্জিন, একটি স্পেয়ার এপিইউ কেনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৩১ কোটি ২৩ লাখ ডলার ঋণ দেওয়া হয়। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। দুটি ধাপে এ ঋণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ছাড় করা হয় ২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। দ্বিতীয় ধাপে একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর ছাড় করা হয় ২৮ কোটি ৮২ লাখ ডলার। এর সুদের হার নির্ধারণ করা হয় তিন মাস মেয়াদি লাইবর রেটের (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেট) সঙ্গে আরও দেড় শতাংশ যোগ করে। ওই সময়ে লাইবর রেট ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর সঙ্গে দেড় শতাংশ যোগ করলে সুদের হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এই সুদ ও সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা বিনিময় হারে এ বছরের শুরুর দিক পর্যন্ত ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার যে বিনিময় হার হবে ওই দামে ও সুদের হারে ঋণ পরিশোধ করার শর্ত ছিল। এ বছরের মে মাস থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন থেকে ঋণ পরিশোধে অর্থের পরিমাণও বাড়তে শুরু করে।
মে থেকে ডলারের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে থাকলে ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে যায়। ডলারের দাম বাড়ায় ঋণের একটি কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংককে নিজস্ব তহবিল থেকে ২ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে। পরের কিস্তি পরিশোধের জন্য ১১ মে সোনালী ব্যাংক থেকে হিসাব করে বিমানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। এতে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয় ৯১ টাকা ৫০ পয়সা। ওই সময়ে প্রথম ধাপে কিস্তির ৬ লাখ ৮৯ হাজার ডলার বাবদ স্থানীয় মুদ্রায় আসে ৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু এক মাস পর ঋণের প্রথম ধাপের কিস্তি পরিশোধের সময় ১৪ জুন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ টাকা ৪০ পয়সায়। দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় মুদ্রায় টাকার পরিমাণও বেড়ে ৬ কোটি ৪৪ লাখ হয়। শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ১৩ লাখ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়। একইভাবে দ্বিতীয় ধাপের কিস্তি বাবদ ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা দাঁড়ায় ৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। কিন্তু পরিশোধের সময় ২১ জুন বিনিময় হার দাঁড়ায় ৯৩ টাকা। এতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৭৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা হয়। প্রায় দেড় মাসের মাথায় ঋণের পরিমাণ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেড়ে যায়। তাতে দেখা গেছে, ওই দুটি কিস্তিতে বেড়ে যায় ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
সেপ্টেম্বরে পরিশোধিত দুটি কিস্তির জন্য বিনিময় হার ধরা হয় ১১১ টাকা। প্রথম ধাপে ৭ লাখ ৩২ হাজার ডলারের বিপরীতে ঋণের শুরুর দিকে বিনিময় হার ৮৫ টাকা। সে হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় দাঁড়ায় ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। ঋণ পরিশোধের সময় ১১১ টাকা ধরে দাঁড়ায় ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তাতে দেখা গেছে ঋণ বেড়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় ধাপের ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের বিপরীতে প্রথমে স্থানীয় মুদ্রায় আসে ৭৬ কোটি টাকা। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে এর পরিমাণ বেড়ে হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ খাতে ঋণ বেড়েছে ২৪ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী তিন কিস্তিতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে ঋণ বেড়েছে ২৯ কোটি টাকা। সব মিলে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ১০৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
(আহৃত)