বাংলার আকাশ ডেস্ক:-
সবকিছুর দামই বাড়তি। ঘর থেকে বের হলেই মুহূর্তেই খালি হয়ে যায় ভোক্তার পকেট। যেখানেই হাত বাড়ায়, সেখানেই অগ্নিমূল্য। যেন হাত পুড়ে যায়। সকালের নাশতা থেকে শুরু করে তিন বেলার খাবারসহ নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে।
বেড়েছে লঞ্চ-বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহণ ভাড়া। বাসায় থাকারও উপায় নেই। প্রতিদিনই বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ানোর চাপ। জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কিনতেও ধাক্কা-বেড়েছে অস্বাভাবিক দাম। এমনকি লন্ড্রির
বিল, সেলুনে চুল কাটানোতেও বাড়তি ব্যয়। কিন্তু আয় তলানিতেই, কোনোভাবেই বাড়ছে না, অনেক ক্ষেত্রে কমছেও। রীতিমতো হাঁসফাঁস করছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। তাদের অভিমত-‘আমরা অসহায়, আমাদের কষ্ট শোনার কেউ নেই। জীবন আর চলছে না।’
বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত চিত্র। এদিন ঢাকার কাওরান বাজার, মালিবাগ, নয়াবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা বেড়ে সাধারণ মানের প্রতি কেজি চাল কিনতেই ক্রেতার ৫৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে। ডাল, ভোজ্যতেল, ব্রয়লার মুরগির দাম লাগামহীন। শুধু ডিম ভাজি করে ভাত খাবে, এরও উপায় নেই।
প্রতি হালি কিনতে ৫৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। বাজারে সাধারণত যেসব মাছ কম দামে পাওয়া যায়-পাঙাশ ও তেলাপিয়া, সেগুলোর দামও কেজিতে ৬০-৭০ টাকা বেড়েছে। ভর্তা তৈরির উপকরণ আলু, পেঁয়াজ ও মরিচের দামও বেশি। এছাড়া পাউরুটি, বিস্কুট, চানাচুর, নুডলসসহ সকাল ও বিকালের নাশতার তালিকার পণ্য ১০-৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক ক্রেতা বাজারে এসে ক্রয়ের তালিকায় কাটছাঁট করছেন। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাড়ি ভাড়া ২ থেকে ৪ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। যাদের বাড়েনি, তাদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। আর বেশ আগেই বেড়েছে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল। সব মিলে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। যারা সবাই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের।
এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সবকিছুর দাম বেড়েছে। সম্প্রতি আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী মিনিবাস এবং ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ০৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ১০ ও ৮ টাকা নির্ধারিত হয়েছে।
তবে বাস্তবে এর চেয়ে বেশি ভাড়া রাখা হচ্ছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ৩০ শতাংশ লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। পণ্য পরিবহণে ভাড়া নির্ধারণ না করায় ইচ্ছামতো আদায় করছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে বাজারে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে না পেরে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। পণ্যের দামে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তা। বাজারে কী পরিমাণে পণ্যের দাম বাড়া উচিত এবং কী পরিমাণে বেড়েছে-এ খবর রাখতে কোনো সংস্থাকে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে যে যার মতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি শুরু করেছে। এতে সব শ্রেণির ক্রেতা ভোগান্তিতে পড়ছে। বেশি কষ্টে আছেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ।
বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যেখানে প্রতি কেজি চাল ৫০ পয়সা বাড়ার কথা, সেখানে ব্যবসায়ীরা ৪ টাকা বাড়িয়েছেন। তবে মন্ত্রীর কথার সঙ্গে বাজারের চিত্র ভিন্ন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা বেড়েছে। এদিন রাজধানীর কাওরান বাজার, মালিবাগ বাজার ও নয়াবাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৬ টাকা, যা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ৪৫-৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছ ।
প্রতি কেজি বিআর ২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকা, যা আগে ছিল ৫৫ টাকা। প্রতিকেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা, আগে ছিল ৬৮-৭২ টাকা। নাজিরশাল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫-৯০ টাকা, যা আগে ৭০-৮৫ টাকা ছিল।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু এর মানে এই নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।’
কাওরান বাজারের আল মদিনা রাইস এজেন্সির মালিক ও চাল বিক্রেতা সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘মূলত মিলাররা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগ থেকেই চালের দাম বাড়াচ্ছিল। ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম বেশি পড়ায় তারা কারসাজি করে দেশীয় চালের দাম কেজিতে ৪-৬ টাকা বৃদ্ধি করে। পরে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর যেখানে কেজিপ্রতি ৫০-৮০ পয়সা বাড়ার কথা, তখন পাইকারি সিন্ডিকেট ৫-১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেছে। এতে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। ফলে ক্রেতারা চাল কিনতে ভোগান্তিতে পড়েছেন।’
এদিকে খুচরা বাজারে বুধবারও প্রতি হালি ডিম ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ৪২ টাকা ছিল। প্রতি কেজি মসুর ডাল ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ১২৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ১৬৫-১৭০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৫৫ ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ৪৫ ও ৪০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা, যা আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তেলাপিয়া মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা, যা আগে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কই মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২৪০ টাকা, যা সাত দিন আগেও ১৬০-১৮০ টাকা ছিল।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় আকারের পাউরুটি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা, যা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ৮০-৮৫ টাকা ছিল। ৩০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট চানাচুর বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা, যা আগে ৭৫ টাকা ছিল। ৮ পিসের প্যাকেট নুডলস বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, যা আগে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা আগে ৩৮ টাকা ছিল। ১০ টাকা বেড়ে পাইনাপেল বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি টোস্ট বিস্কুট বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, যার দাম ১৪০ টাকা ছিল। প্রতি লিটার কোক ৫ টাকা বেড়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রাণ সসের বোতল ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, আগে ৬২ টাকা ছিল।
কাওরান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আসা মো. আব্দুল নাঈম বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। সকালের নাশতা থেকে শুরু করে তিন বেলার খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। দাম বাড়ায় এখনই কম করে পণ্য কিনতে হচ্ছে। আর এভাবে পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে পরিবার নিয়ে না-খেয়ে থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, শুধু বাজারেই পিষ্ট হচ্ছি তা কিন্তু নয়। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে পানি ও বিদ্যুৎ বিল-সবকিছুর দামই বেড়েছে। আগে যেখানে বাসে ১০ টাকা দিয়ে যেতে পারতাম, সেখানে এখন ১৫-২০ টাকা লাগছে। এছাড়া একটি শার্ট আয়রন করতে ২ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। চুল কাটাতে দিতে হচ্ছে ৩০ টাকা বেশি। ফলে সব খরচ একসঙ্গে বহন করতে নাজেহাল হতে হচ্ছে।
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. ইসহাক বলেন, ‘সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। সাধারণত নাপা সিরাপের বোতল ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাকের অ্যান্ট্রাজল ড্রপ ১০ টাকা ছিল, এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সঙ্গে ২৪ টাকার অ্যামোক্সিসিলিন ইনজেকশন ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২১ টাকার প্রমেথাজিন ৩৫ টাকা হয়েছে। এমন করে সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। জীবন রক্ষা যেন এখন দায়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সচেতনতা অনেক বড় ব্যাপার। তারা যৌক্তিক লাভ করবে, এটাই আমরা চাই। কিন্তু কেউ যদি কারসাজি করে, এদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান টিম প্রতিনিয়ত তদারকি করছে।’