অনেক প্রতিকূলতা ও বাধা ডিঙিয়ে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক ও দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সত্যি অবিশ্বাস্য।
সরকারের ধারাবাহিকতা, সদিচ্ছা— সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এই সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবহেলিত অঞ্চলকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসবে।
অর্থনীতি ও জিডিপিতেও এই সেতু মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত।
পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই বিশাল বিনিয়োগের প্রাপ্তি হিসাবের দুটি উপায় আছে। একটি হলো— মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি বিবেচনা, অন্যটি সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায়ের মাধ্যমে সরাসরি খরচ উঠিয়ে আনা।
কোন উপায়ে কত বছরে পদ্মা সেতুর ব্যয় উঠে আসতে পারে, সরকারিভাবে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এই সেতু দিয়ে দেশের ২৩ জেলায় প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, যা ২০২৫ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৬০০। এদের সবার থেকে টোল বাবদ যে আয় হবে, শুধু তা দিয়ে সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৯ বছর।
অন্যদিকে সেতু চালু হওয়ার কারণে আগামী এক বছর বা ১২ মাসে অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি যোগ হবে চলতি বাজারমূল্যে ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, যা জিডিপির ১.২ শতাংশের সমান।
এই বিবেচনায় মাত্র ৯ মাসে উঠে আসবে ৩১ হাজার ৭৭১ কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে মাত্র এই ৯ মাসের প্রাপ্তি হবে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান।
এদিকে আইসিএবির এক প্রবন্ধে বলা হয়, পদ্মা সেতু হলে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ এবং ১০ বছরে ওই সব জেলায় ৩০-৪০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় আগামী ১০ বছরে ৫০০-১০০০ নতুন কারখানা স্থাপন হবে। ফলে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে দেশের অর্থনীতিতে। এই সেতু চালু হওয়ার পর ভারত ও নেপাল থেকে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে। পর্যটনশিল্পে বিপ্লব ঘটবে। সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের ওপর চাপ কমবে।
বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, ৩ কোটি মানুষ পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এ সেতু হওয়ায় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে। ফলে তারা এই সেতুকে অর্থনৈতিক করিডর হিসাবে ব্যবহার করায় বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হবে। সেতুটির ফলে সরাসরি সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে মোংলা, পায়রা, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কসহ ভারতের সাত প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমে আসবে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, এডিবির মতে আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পারে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে যে টাকা এই সেতুতে খরচ হয়েছে তা আগামী ৩০ বছরে সুদসহ অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেওয়া যাবে।
এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, সেতু নির্মাণে সরকারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
লোন রিপেমেন্ট শিডিউল অনুযায়ী প্রথম বছরেই ৫৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আবার কোনো কোনো বছর পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পর্যন্ত।
গত ১৭ মে পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করছে, প্রথম বছরে টোল আসবে ১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টোলের বেশিরভাগ টাকা দিয়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ করা হবে। বাকিটা খরচ হবে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। ৩৫ বছরে সরকারকে সুদে-আসলে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধ, সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ, নদীশাসন এবং আদায়কৃত টোলের ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধে টাকা প্রয়োজন। এ টাকা টোল থেকে সংগ্রহ করা হবে।
(আহৃত)