নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বছরের ব্যবধানে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, মসলাজাতীয় পণ্য প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত এবং অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার লাগামহীন হয়ে পড়েছে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জীবনযাত্রার অন্যান্য সেবায়। যেমন: শিক্ষা, যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় না বাড়ায় সংকটে পড়েছেন মধ্যবিত্ত।
বাজারের চাপে পিষ্ট হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, বছরের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ।
প্রতি কেজি আটা ৩৯.৭১ শতাংশ ও ময়দা ৬৪.৭৯ শতাংশ দাম বেড়েছে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৪৬.৬৭, পাম তেল ৫১.৫০, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৩৮.৭১, আলু ৯.৩০, পেঁয়াজ ২৩.৫৩, রসুন ১২, মরিচ ৩৪.৬২, হলুদ ৩৫.২৯, গরুর মাংস ১৬.৬৭, খাসির মাংস ৫.৮৮, ব্রয়লার মুরগি ১৭.৩১, শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ ২১.৮২, চিনি ১৮.৮৪, লবণ ১.৫৮ এবং প্রতি হালি ফার্মের ডিম ১৯.৭২ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যের দাম বাড়লেও গত এক বছরের ব্যবধানে আয় বাড়েনি। উলটা অনেকের আয় কমেছে।
ফলে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হচ্ছে। খাদ্য বাজেটে কাটছাঁট করায় পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপেও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগার তথ্য উঠে এসেছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। এর চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সব মিলে এ দুই শ্রেণির মানুষ আয়ের সঙ্গে পরিবারের ব্যয় সামলাতে পারছেন না। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বের করে আনতে হবে। পণ্যের দাম কমাতে কঠোর বাজার তদারকি করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বেশি করে পণ্য ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে ছাড়তে হবে।
ব্যবসায়ীদের একটি নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। এছাড়া জীবনমান ভালো রাখতে জ্বালানি, পানি ও গ্যাসের দাম কমাতে হবে। রাজধানীর কাওরান বাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও নয়াবাজার ঘুরে এবং খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকা, যা গত বছর একই সময় ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতি কেজি ভালোমানের মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা গত বছর একই সময় বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা। প্রতি কেজি প্যাকেট আটা বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা এক বছর আগে ৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতি কেজি প্যাকেট ময়দা ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা গত বছর একই সময় বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। প্রতি লিটার খোলা ও বোতল সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৯৫ ও ২০৫ টাকা, যা এক বছর আগে দাম ছিল ১৩০ ও ১৬০ টাকা।
প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডাল ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছর প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০ টাকা বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা। আমদানি করা রসুন ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ১৩০ টাকা ছিল।
বাজার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি ২৮০ টাকা আমদানি করা মরিচ এখন বিক্রি হয়েছে ৩৮০ টাকা। কেজিপ্রতি ১৮০ টাকার হলুদ ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৮০-৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক বছর আগে ৫৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকা, যা আগে ৮৫০-৯০০ টাকা ছিল।
বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি ১৩০ টাকা ব্রয়লার মুরগি ১৬০-১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ প্রতি কেজি ৭০০-৭৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা গত বছর একই সময় দাম ছিল ৫৬০-৬৫০ টাকা। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮৪-৮৫ টাকা। যা আগে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি হালি ফার্মের ডিম ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর নয়াবাজারে কথা হয় একটি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা মো. রকিবুল হাসানের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দুই মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমার পরিবার। বংশাল এলাকায় থাকি। চাকরি করে বেতন পাই ৪০ হাজার টাকা।
এই বেতন দিয়ে গত দুই বছর আগেও পরিবার নিয়ে বেশ ভালো ছিলাম। কিন্তু এখন ভালো নেই। সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছি না। অভাব কাটছে না। প্রতিমাসেই ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। তিনি জানান, চাল থেকে শুরু করে ডাল, এমনকি চিনি-লবণ পর্যন্ত বাড়তি দরে কিনতে হয়। পেঁয়াজ ও তেলের দাম আকাশচুম্বী। মাংস তো কেনাই যায় না। সবজির দামও অনেক।
কাওরান বাজারে মালামাল বহন করেন শ্রমিক মো. খলিল। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ঘরে মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে। আমি দিন আনি দিন খাই। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, এখন আমার আয় দিয়ে খাবার জোগানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাদের খাবার ছাড়াও অন্যান্য খরচ আমারই বহন করতে হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে হাতিয়ার করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
মনে হচ্ছে, গত রমজান থেকে অসাধু বিক্রেতারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এতে দাম বাড়ছে, নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতার।
তবে ভোক্তার স্বস্তি ফেরাতে আমরা বসে নেই। বিশেষ তদারকি টিম করে বড়-ছোট সব স্থানে অভিযান পরিচালনা করছি। যেখানে অনিয়ম, সেখানেই গিয়ে আইনের আওতায় আনছি। আশা করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
(আহৃত)