আগামী বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে নানা উদ্যোগ থাকছে। এজন্য শিল্পের করপোরেট কর হ্রাস; কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে কর হ্রাস; বিদেশে পাঠানো রয়্যালটি, কারিগরি সহায়তা ফির উৎসে কর হ্রাস, স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখার পাশাপাশি নতুন শিল্পে অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে থাকছে বিদেশে পাচারের টাকা দেশের অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) সুবিধা দেওয়া। পাশাপাশি কর জাল বাড়াতেও টিআইএনের (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রিটার্ন জমা স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। একইসঙ্গে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে স্পট অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে করারোপ : আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খেলাপি ঋণের ওপর করারোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ মওকুফ করলে তা করমুক্ত রয়েছে। বাজেটে ব্যক্তি করদাতা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হলে তা করযোগ্য আয় হিসাবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। মন্দ ঋণের প্রবণতা হ্রাস করতেই বাজেটে এ পদক্ষেপ থাকছে।
সমুদ্রগামী জাহাজের আয় করমুক্ত : করোনায় পণ্য পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসাকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ থাকছে। এর অংশ হিসাবে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের বহির্বিশ্বে সেবা প্রদানের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে তার ওপর ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর দিতে হবে না।
সব রপ্তানি খাতে একই হারে কর : বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে করপোরেট কর সাধারণ গার্মেন্টসের জন্য ১২ শতাংশ এবং সবুজ কারখানার জন্য ১০ শতাংশ। অথচ পশ্চাৎপদ শিল্প হিসাবে এক্সেসরিজ শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাদের নিয়মিত হারে (৩০ শতাংশ) আয়কর দিতে হয়। পাট, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক, চামড়া খাতে বৈষম্য আছে। আগামী বাজেটে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণকে উৎসাহ দিতে সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্পের করপোরেট কর তৈরি পোশাক শিল্পের মতো ধার্য করা হচ্ছে।
দোকানে রিটার্ন স্লিপ না ঝোলালে জরিমানা : আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যবসা কেন্দ্র বা দোকানে টিআইএনের (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) পরিবর্তে রিটার্ন জমার স্লিপ ঝোলানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। মূলত সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে আয়কর অধ্যাদেশে এ সংশোধনী আনা হচ্ছে।
কোম্পানির সুদ আয়ে দ্বিগুণ কর : কোম্পানির সুদ আয়ে দ্বিগুণ কর আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়, এটি বাজেটে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রিটার্ন জমার স্লিপ না দিলে অতিরিক্ত আরও ৫০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। অবশ্য স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড, সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ড ও পেনশন ফান্ডের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে তার সুদ আয়ের ওপর ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। যদিও ব্যক্তি করদাতাদের সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর আগের মতো ১০ শতাংশ থাকছে।
কর বকেয়া থাকলে গ্যাস-বিদ্যুৎ পানির সংযোগ কাটা যাবে : কর বকেয়া থাকলে সময়-সুযোগমতো দিয়ে দিন। কারণ বাজেটে সার্টিফিকেট (কর আদায়ের নোটিশ) ইস্যুর পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ফলে আয়কর বিভাগ সংশ্লিষ্ট সেবা সরবরাহকারী বিভাগকে নোটিশ পাঠাতে পারবে। নোটিশ প্রাপ্তির ২১ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে সেবা সরবরাহকারী সংস্থাকে। নইলে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হিজড়া-প্রতিবন্ধীদের নিয়োগে কর ছাড়ের শর্ত শিথিল : হিজড়া-প্রতিবন্ধীদের নিয়োগে কর ছাড়ের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আগে ১০০ জন হিজড়া-প্রতিবন্ধীকে নিয়োগের শর্তে প্রদেয় করের ৫ শতাংশ বা তাদের বেতনের ৭৫ শতাংশ কর ছাড় পেত নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এত বিপুলসংখ্যক হিজড়া ও প্রতিবন্ধীকে নিয়োগ দিতে না পারায় কর ছাড় থেকে বঞ্চিত হতো প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই বাজেটে ১০০ জনের পরিবর্তে ২৫ জনকে নিয়োগের শর্তে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।
কর কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দিলে ৫০ লাখ জরিমানা : উৎসে কর আদায় কার্যক্রম গতিশীল করতে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। চাইলে কর কর্মকর্তারা ব্যবসা প্রাঙ্গণে বাধাহীনভাবে প্রবেশ করতে পারবেন। পাশাপাশি অ্যাকাউন্ট বই ও রেকর্ড বই জব্দ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কর কর্মকর্তা বাধার শিকার হলে উৎসে কর্তনকারী প্রতিষ্ঠান বা বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।
বিদেশে সম্পদ থাকলে রিটার্নে দেখাতে হবে : দেশের পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ বা ঋণ থাকলে তা আগামী অর্থবছর থেকে আয়কর রিটার্নে দেখাতে হবে। অর্থ পাচার রোধে ও ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে আইন অনুযায়ী জরিমানা করা হবে।
যাদের রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা নেই : এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড, পেনশন ফান্ড, সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ড, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড, অনিবাসী বাংলাদেশি যাদের স্থায়ী অবকাঠামো নেই- এমন ব্যক্তিদের আয়কর রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
মোটরগাড়ি শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি : মোটরগাড়ি উৎপাদন শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান ফ্রিজ, এসি, টিভি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোবাইল সংযোজন, লিফট সংযোজন শিল্পে এ সুবিধা দেওয়া আছে। তবে ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ায় বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে।
রেস্টুরেন্ট-জুয়েলারি শিল্পে ভ্যাট কমছে : এখন এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগে এসি রেস্টুরেন্টে ১০০ টাকা খেলে ১০ টাকা ভ্যাট দিতে হতো, বাজেট পাশ হলে আগামী ১ জুলাই থেকে সেখানে ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। অবশ্য ৫ তারকা হোটেলে খেলে ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট দিতে হবে। এছাড়া জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে।
(আহৃত)