পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের সময় ও বাসভাড়া দুই-ই কম আসবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পরিবহণ মালিকরা। ঢাকার সঙ্গে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের বেশিরভাগ জেলার দূরত্বও কমে আসবে। ফেরি পারাপারের বাড়তি সময় আর না লাগায় মূলত বাসের ভাড়া কমে আসবে।
ইতোমধ্যে গ্রিনলাইন পরিবহণ বিভিন্ন রুটের বাসের ভাড়া সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত কমানোর কথা জানিয়েছে। অন্য সব পরিবহণ কোম্পানি এখনো ঘোষণা দেয়নি। দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলার ভাড়া কমছে বলে জানা গেছে। ভাড়ার তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকা বিআরটিএ নতুন ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করেনি।
পদ্ম সেতু উদ্বোধনের বাকি আর ২১ দিন। আগামী ২৫ জুন সেতুটির উদ্বোধন করা হবে। এ সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হতে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। পদ্মা সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যাতায়াতে অনেক দূরত্ব কমে আসবে। স্বাভাবিকভাবে ভাড়াও কমে আসবে। আমরা ফেরির ভাড়া ও সেতুর টোল সমন্বয় করে শিগগিরই ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করব।
কয়েকজন পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমানে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের বেশিরভাগ জেলায় অধিকাংশ বাস পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট হয়ে ফেরি পার হয়ে যাতায়াত করছে। এতে দূরত্ব ও সময় দুই-ই বেশি লাগছে। পদ্মা সেতুতে গাড়ি চালুর পর তা কমে আসবে। এতে বাসের ট্রিপের সংখ্যা বাড়বে। সময় সাশ্রয় ও স্বস্তি থাকায় মানুষের যাতায়াতও বাড়বে। সব মিলিয়ে তারা ভাড়া কমিয়ে যাত্রী পরিবহণ করতে পারবেন। এসব সুবিধা বিবেচনায় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানি গাড়ি নামাতে যাচ্ছে। বিশেষ করে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা রুটে বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে রাজধানীর গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ফেরি হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বরিশালের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। বিআরটিএর হিসাবে ৪০ আসনবিশিষ্ট নন-এসি বাসে ফেরির টোলসহ যাত্রীপ্রতি ভাড়া ৬২৬ টাকা। ফেরি পারাপারের কারণে ২-৩ ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে। একটি বাস ২৪ ঘণ্টা এ রুটে সর্বোচ্চ দুটি ট্রিপ দিতে পারছে। অপরদিকে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। এ হিসাবে দূরত্ব কমে আসবে ৮৬ কিলোমিটার। ৪০ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটার যাত্রী ভাড়া এক টাকা ৮০ পয়সা হিসাবে ৮৬ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া কমবে ১৫৪ টাকা। সময় লাগবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা। একটি বাস ২৪ ঘণ্টায় চারটির বেশি ট্রিপ দিতে পারবে। বিআরটিএ হিসাবে বর্তমানে এ পথের ভাড়া ৪০১ টাকা। তবে এর সঙ্গে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ও সেতুর টোল যুক্ত হয়ে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করবে বিআরটিএ। সার্বিকভাবে এ রুটের ভাড়া কমবে বলে জানিয়েছেন পরিবহণ মালিকরা।
একইভাবে গাবতলী থেকে পাটুরিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত বর্তমান দূরত্ব ২৯২ কিলোমিটার। নন-এসি বাসে এ দূরত্বের ভাড়া ৭৩৭ টাকা। বর্তমানে এ দূরত্ব যেতে সময় লাগছে ৭-৯ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে ওই দূরত্ব দাঁড়াবে ২৪৭ কিলোমিটারে। সময় লাগবে ৪-৫ ঘণ্টা। কমে আসবে ভাড়াও। একইভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলার দূরত্ব কমে আসবে।
গ্রিনলাইন পরিবহণের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সাত্তার জানান, তাদের এসি বিজনেস ক্লাসের বাসে ঢাকা থেকে খুলনা ভাড়া এক হাজার ৪০০ টাকা। পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি গেলে তখন ওই ভাড়া ২০০ টাকা কমিয়ে এক হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হবে। একইভাবে ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৮০০ টাকা নেওয়া হবে। অপরদিকে ঢাকা থেকে বরিশাল বিজনেস ক্লাসের বাসে এক হাজার ২০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ওই ভাড়া কমিয়ে এক হাজার টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন সামনে রেখে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় বাসের নতুন রুট নির্ধারণ করেছে বেশ কিছু কোম্পানি। এনা পরিবহণ, ইউনিক পরিবহণ, সৌদিয়া, এস আলমসহ কয়েকটি বাস কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের নতুন কাউন্টার স্থাপন করেছে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতেও নতুন নতুন রুট ঘোষণা করেছে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানি। পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় এসব রুট লাভজনক মনে করছে কোম্পানিগুলো।
শ্যামলী এনআর পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হতে যাওয়ায় আমরা দক্ষিণাঞ্চলের রুটে গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আর ফেরির জন্য ঘাটে বসে থাকতে হবে না। সময় ও দূরত্ব কমে আসায় ভাড়াও কমবে বলে মনে করি।
তবে তিনি জানান, গাবতলী বা উত্তরা থেকে গাড়ি পোস্তগোলা পৌঁছানোর জন্য পৃথক কোনো সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। এ কারণে ঢাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথগুলোতে যানজট তৈরি হতে পারে।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সাকুরা পরিবহণের মালিক ও বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, গাবতলী থেকে যেসব কোম্পানির বাস চলাচল করছে, সেসব কোম্পানি পদ্মা সেতুর সুফল কীভাবে পাবে সে বিষয়ে সরকারের এখনো নির্দেশনা পাইনি। আমরা পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে চাই। সেজন্য ঢাকার ভেতরের পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে।
(আহৃত)