রাজধানীর রমনা অফিসার্স কোয়ার্টারে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মোহাম্মাদ তারিকের বাসা থেকে গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই গৃহকর্মীর নাম মৌসুমি আক্তার (১৪)।
বুধবার সন্ধ্যায় লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে নেওয়া হয়। এ মৃত্যু নিয়ে গৃহকর্মীর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
তাদের অভিযোগ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেই মৌসুমিকে হত্যা করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরে গৃহকর্মীকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।
তবে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা মনে করলেও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় বুধবার রাতে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন নিয়েও মৌসুমির স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, গৃহকর্মীর মৃত্যুর পর থেকেই নানাভাবে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত আইজিপি ও রাজশাহীর সারদার বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ আবু হাসান মোহাম্মাদ তারিককে একাধিকবার কলা করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠিয়ে সাড়া মেলেনি পুলিশের ১২ ব্যাচের দাপুটে এ কর্মকর্তার।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. শামিমা আফরোজ লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। পুলিশ জানিয়েছে, বাহ্যিকভাবে তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
আপাতদৃষ্টে আত্মহত্যা মনে হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ মতামত ছাড়া চূড়ান্তভাবে তা বলার সুযোগ নেই। এছাড়া মৃত্যুর বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে আমরা ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে। তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মী ওই বাসায় স্থায়ীভাবে ছিল। ঘটনার সময় বাসায় কেউ ছিল না। তবে অন্য সময় বাসায় সবাই থাকেন।
এদিকে মৌসুমী আক্তারের (১৩) মৃত্যুর খবরে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। দরিদ্র ঘরের সন্তান হলেও আচার-আচরণে সবার কাছে সে ছিল আদরের। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না প্রতিবেশীরাও।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মৌসুমির লাশ তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে পৌঁছায়। এ সময় কফিন ঘিরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।
গ্রামবাসীকে তখন অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় দেখা যায়। তারা বলেন, ‘এ হত্যার বিচার কি হবে তা জানার পরেই লাশ দাফন হবে।’ পরে থানার ওসিসহ পুলিশের একটি টিম সেখানে যায়।
তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এ সময় মেয়ের লাশের পাশে বসে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা ফরিদা। মৌসুমীর মা ফরিদা বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমার মৌসুমী আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, মাসুদ দারোগা আমার মৌসুমীকে কাজের জন্য পুলিশ অফিসারের বাসায় দেয়। সেখানে তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। বাড়ি আসতে চাইলেও আসতে দেয় নাই। আমরা দেখা করতে গেলে দেখা করতে দেয় নাই।
তিনি আরও জানান, আমার মৌসুমীর সাথে শেষ কথা হয় গত রোজার মাসে। মাসুদ দারোগা ওই বাসায় নিয়ে গেলে দুই মিনিটের বেশি থাকতে দেয় নাই। কোনো কথাও বলতে দেয় নাই।
তিনি আরও বলেন, তিন বছর ধরে অভাবের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম তার বাবা মুক্তার হোসেন মারা যান চার বছর আগে। বাবা মারা যাওয়ার এক বছর পর স্থানীয় দড়ি চৈথট্র গ্রামের মাসুদ দারোগা মৌসুমীকে ঢাকার অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মুহম্মদ তারিকের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে দেয়।
পুলিশ জানায়, বুধবার বিকাল ৫টার দিকে অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মোহাম্মাদ তারিকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য বাসায় যান। এ সময় বাসার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর দরজা না খোলায় ওই পুলিশ সদস্য বিষয়টি পার্শ্ববর্তী রমনা থানায় জানান। আবু হাসানের পরিবারকেও জানানো হয়।
জানতে চাইলে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দীন মিয়া জানান, ওই বাসায় অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসানের স্ত্রী ও সন্তানেরা থাকেন।
ঘটনার সময় তার স্ত্রী অফিসে ছিলেন, বাচ্চারাও বাইরে ছিল। এক পুলিশ সদস্য বাসায় গিয়ে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না। পরে তার স্ত্রী এসে দরজা খুলে ওই গৃহকর্মীকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গৃহকর্মীর পরিবারের কাছ থেকে মৃত্যুর বিষয়ে সুষ্পষ্টভাবে কোনো অভিযোগ পাইনি। এলে মামলা হবে। আইন সবার জন্যই সমান।
এদিকে ঘাটাইলের বাড়িতে ভুক্তভোগীর নানী মাজেদা (৬৫) বলেন, ‘বুধবার মাগরিবের নামাজের পর মাসুদ দারোগা আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিছি তোমরা ঢাকায় আস। আমি কইলাম আমরা ঢাকায় আসমু কেন? তহন বলে তোমার নাতনি মৌসুমী অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। এ কথা শুনে আমি আমার আরেক নাতিকে নিয়ে ওই গাড়িতে চড়ে ঢাকায় যাই। ঢাকায় গেলে আমাদের এখানে ঘুরায় ওখানে ঘুরায়, কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যায় না। মৌসুমীকেও দেখায় না। সারা রাইত গেছে আজকে (বৃহস্পতিবার) পর্যন্তও আমাদের দেখানো হয় নাই। সারা দিন গেছে আমরা মৌসুমীকে দেখতে পারি নাই।’ একই কথা জানান তার বড় বোন শিল্পী।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান হীরা বলেন, আমি ঘটনাটি বুধবার রাত ১১টার দিকে জানতে পারি। ঘটনাটা যাই হোক আমরা দাফনের ব্যবস্থা করি। শুক্রবার ওই পুলিশ কর্মকর্তা আসবেন। তিনি পরিবারের জন্য একটা কিছু করবেন।
ঘাটাইল থানার ওসি আজহারুল ইসলাম সরকার বলেন, কোনো কথাই অনুমান করে বলা যাবে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেটা আসবে, যদি সেখানে হত্যা, আত্মহত্যা যাই আসুক সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(আহৃত)