রাজধানীর শাহজাহানপুরের ব্যস্ত সড়কে ফিল্মি স্টাইলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যার সমন্বয়কারী মুসা দুবাই থেকে ওমানে পালিয়েছেন। ওমান পৌঁছে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এ মাসের শুরুতে ওমান যাওয়ার পর সেখান থেকে মতিঝিলের ফুটপাতসহ বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণকারীদের ফোন করে টাকার ভাগ চেয়েছেন। ফোনেই দিচ্ছেন হুমকি-ধমকি। ওমান যাওয়ার পূর্বে টিপুর স্ত্রী ও তার স্বজনদের ফোনে হুমকি দিয়েছেন। টিপুর ঘনিষ্ঠজনদেরও বেছে বেছে হুমকি দেন। পরে তার বিরুদ্ধে শাহজাহানপুর ও মতিঝিল থানায় অন্তত তিনটি জিডি করা হয়েছে। ওমান পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে পুলিশ সদর দপ্তর। তবে তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে হত্যার দুই মাস পরও গুরুত্বপূর্ণ আলামত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার হয়নি। শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ গ্রেফতার হলেও তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলের চালক মোল্লা শামীম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে করে হত্যার সময় ‘একাধিক অস্ত্রের ব্যবহার’ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেও এর নেপথ্যের অনেক ঘটনা এখনো রহস্যে ঘেরা। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টিপুর পরিবার ও তার রাজনৈতিক অনুসারীরা। স্বামী হত্যার বিচার ও অনিরাপত্তার বিষয়ে জানাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎও করেছেন টিপুর কাউন্সিলর স্ত্রী।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ওমানে মুসার অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। সে দেশের পুলিশের পাঠানো পাসপোর্ট নম্বরের সঙ্গেও মুসার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বরের মিল পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক মহিদুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ওমানে যাওয়ার পর আমরা তাকে নজরদারিতে রাখতে বলেছি। ওমানের পুলিশ তাদের নজরদারিতে রেখেছে। তবে তাকে ফেরানোর ব্যাপারে বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবির সঙ্গে এনসিবির মৌখিক যোগাযোগ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সূত্র ও টিপুর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এ মাসের শুরুতে মুসা দুবাই থেকে ওমান যান। সেখানে যাওয়ার পর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চাঁদা চাইছেন, বিভিন্নজনকে হুমকি দিচ্ছেন। টিপুর স্ত্রীকে হুমকি দেন। হুমকি দেওয়া হয়েছে তার স্বজনদেরও। এ নিয়ে টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওযার্ড কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলিসহ তার অনুসারীরা শাহজাহানপুর ও মতিঝিল থানায় অন্তত তিনটি জিডি করেছেন। টিপুর স্ত্রী সাক্ষাৎ করে এই বিষয়গুলো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দপ্তর সম্পাদক ও তথ্য মন্ত্রীকে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি অবগত করেছেন তিনি। তবুও থামছে না মুসার তৎপরতা। এ অবস্থায় মামলার গতি ত্বরান্বিত করতে মুসাকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মোল্লা শামীমকে হন্য হয়ে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। খুব শিগগিরই সুসংবাদ দেওয়া যাবে বলেও আশা তাদের।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি জানিয়েছে, টিপু হত্যার স্থান থেকে দুই ধরনের গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছিল। সে কারণেই তাদের ধারণা, একাধিক অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। তবে একই অস্ত্রে দুই ধরনের গুলিও ব্যবহার হতে পারে। এছাড়া কমলাপুরের ক্লাব থেকে দামাল নামের যাকে গ্রেফতার করা হয় তার কাছ থেকেও একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এই আলামতগুলো পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। এখনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এর বাইরে একটি মোটরসাইকেল ডিবির নজরদারিতে আছে। তবে হত্যা বাস্তবায়নের সময় সেটিই ব্যবহার হয়েছিল কিনা- তা মোল্লা শামীমকে না ধরা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না তারা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম রোববার বিকালে বলেন, নতুন করে মামলায় তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তদন্তে যেসব নাম এসেছে তাদেরকে ধরার চেষ্টা চলছে।
এদিকে টিপুকে হত্যার পর থেকেই বিভিন্ন বিদেশি নম্বর থেকে অনবরত হুমকি আসছে টিপুর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। গত ১ এপ্রিল টিপুর শাহজাহানপুর থানায় একটি জিডি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, দুবাই থেকে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করে হুমকি দেন। ১৩ এপ্রিল মতিঝিল থানায় নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেন এজিবি কলোনি কাঁচাবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, ১১ মার্চ তার কাছে একটি কল আসে। তিনি নিজেকে মুসা পরিচয় দিয়ে টাকা দাবি করেন। কিসের টাকা দেব জানতে চাইলে কলার বলেন, ‘আমি যা বলছি বিষয়টি মাথায় রাইখেন।’ এ কথা শুনে কলটি কেটে দেই। জানতে চাইলে টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, আমি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। এ ঘটনায় জিডির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো দুই সদস্যের প্রতিনিধির কাছেও বিষয়টি আমি জানিয়েছি। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই, পরিবারের নিরাপত্তা চাই। মামলার তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার না হওয়ায় গ্রেফতার আসামিরাও হয়তো জামিন পেয়ে যাবে। তখন নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়বে। এজন্য হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারীদের পাশাপাশি এর নেপথ্যের নায়কদেরও ধরতে হবে। গ্রেফতারকৃতদের চলাফেরা-ওঠাবসায় যারা বুদ্ধি-পরামর্শ দিত তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ ২০২২ তারিখ রাত সাড়ে ১০টায় শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সড়কে প্রকাশ্য গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এছাড়া ঘটনাস্থলে একজন নিরীহ কলেজছাত্রীও নিহত হয়।
(আহৃত)