লোকাল, মেইল ও আন্তঃনগর ট্রেনের প্রায় ৫০ শতাংশ ‘যাত্রী’ টিকিট কাটছেন না। এভাবে বিনা টিকিটে ট্রেন চড়ায় শুধু আন্তঃনগর ১০৫টি ট্রেনে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা আয় বঞ্চিত হচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ২৫৫টি মেইল ও লোকাল ট্রেনেও নির্ধারিত আসনের এক-চতুর্থাংশ যাত্রী টিকিট কাটেন না।
এসব নির্ধারিত আসনের ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি যাত্রী রেলে ভ্রমণ করেন। লোকাল, মেইল ও আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট না কাটায় প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয় রেলকে। রেল সূত্র জানায়, গত ২ বছর ধরে লোকসানের পাল্লা ভারি হয়েছে। দুই বছর ধরে আসনবিহীন (স্ট্যান্ডিং টিকিট) টিকিটও বিক্রি হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন সোয়া দুই লাখ যাত্রী বহন করে রেলওয়ে। এর সঙ্গে বিনা টিকিটের যাত্রী হিসাব করলে সংখ্যাটি তিনগুণ হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদের আগে-পরে প্রতিটি ট্রেনে বিনা টিকিটের যাত্রীর সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ এবং যাত্রীদের অনুরোধে আসনবিহীন টিকিট বিক্রি বন্ধ থাকায় বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ বেড়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে রেলের টিকিট পরীক্ষকের (টিটিই) সংখ্যা নামেমাত্র। আন্তঃনগর ট্রেনে মাত্র ২৫ শতাংশ টিটিই কাজ করছেন। ১০৫টি ট্রেনের মধ্যে ৪০টিতেও তারা যথাযথভাবে অবস্থান করতে পারছেন না। একেকটি ট্রেনে ন্যূনতম ১০ থেকে ১২ জন টিটিই থাকার কথা থাকলেও মাত্র ১-২ জন দায়িত্ব পালন করছেন। বিনা টিকিটের যাত্রী রোধে চলতি মাসে ছয়টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ১ থেকে ২ ঘণ্টা স্থায়ী অভিযানে গড়ে ৩ লাখ টাকা করে আদায় হয়েছে।
সম্প্রতি বিনা টিকিটের যাত্রীর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা নিয়ে আলোচিত টিটিই শফিকুল ইসলাম একেকটি ট্রেন থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করছেন।
রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রেলে ১ টাকা আয় করতে প্রায় ৬ টাকা খরচ হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো- স্টেশনগুলো যথাযথভাবে তৈরি করা হয়নি। কোনো স্টেশনেরই শতভাগ নিরাপত্তা নেই। এ কারণে মানুষ খুব সহজেই প্রবেশ ও বের হতে পারেন। ফলে তারা খুব সহজেই ট্রেনে উঠতে পারেন। দেশের প্রধান দুটি রেলস্টেশন কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশন থেকে যে কেউ খুব সহজেই বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠতে পারেন।
রেলওয়ে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্র জানায়, বিনা টিকিটে ট্রেন চড়ায় একেকটি অভিযানে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ যাত্রীকে আটক করা হয়। প্রায় ৮০ শতাংশ যাত্রীই উন্মুক্ত স্টেশন দিয়ে অথবা আউটারে নেমে পালিয়ে যান। গত বছর ৫৩টি রেলওয়ে স্টেশন সংস্কারের প্রকল্প নেয় রেল। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় অর্ধেকের বেশি সংস্কার করা হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি স্টেশনের সংস্কার কাজ তদারকি করতে মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে ১০টি কমিটি করা হয়েছে। তবে এসব কমিটির সদস্যরা যথাযথভাবে সংস্কার কাজ তদারকি করতে পারছেন না। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্টেশনে নামেমাত্র কাজ হচ্ছে।
আরেক কর্মকর্তা জানান, রেলে উন্নয়নের নামে হরিলুট চলছে। কিন্তু একটি প্রকল্পের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দেশের সবকটি স্টেশনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
অভিযোগ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ উন্নয়ন কাজে রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। বিষয়টি রেলওয়ে বিভাগ ও মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্র জানায়, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও ঠিকমতো পরিচালনা করা যায় না। বিনা টিকিটের যাত্রীসহ স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রায়ই সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রায় ১৫ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হলে বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধ করা সম্ভব হতো। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি হতো। স্টেশনগুলোতে প্রতিনিয়ত চেকিং অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলে দ্বিগুণের বেশি টাকা আয় হতো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক জানান, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চলমান ট্রেনগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত কোচ লাগিয়েও আয় বাড়ানো যেতে পারে। বিনা টিকিটে যাত্রী ভ্রমণ রোধ এবং নির্ধারিত মোট টিকিটের সঙ্গে ২০-২৫ শতাংশ আসনবিহীন টিকিট বিক্রি করা হলে আয় আরও বাড়ত।
(আহৃত)