শেরপুরের শ্রীবরদি উপজেলার বালিজুড়ি এলাকা। সকাল থেকেই বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসের পেছনের বনে ভিড় জমাতে থাকেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। সবার লক্ষ্য একটাই—হাতির পালকে উত্ত্যক্ত করে সেই মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করা। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে ভিউ পাওয়া বা ‘ভাইরাল’ হওয়ার নেশায় হাতিকে ক্ষিপ্ত করছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।
তবে সেই ভিউর লোভ মানুষের জীবন ও ফসলের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢিল ছুড়ে, চিৎকার করে ক্ষিপ্ত করা হলে হাতি স্থানীয় এলাকায় আক্রমণ করতে ছুটে যায়। এতে ধানখেতের ফসলের ক্ষতি বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকিও। এসব ঘটনায় বাধা দিতে গেলে বনবিভাগের স্টাফদের ওপর চড়াও হচ্ছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রাম কাটাবাড়ির বাসিন্দা কাঞ্চন মারাক বেশ কয়েক বছর ধরে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে ফেসবুকে সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছেন।
কাঞ্চন মারাক প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউ পাওয়ার আশায় যেকোনো মূল্যে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা হাতিকে ক্ষিপ্ত করে তোলেন। হাতি মানুষের পেছনে ছুটছেন, বাড়িঘরে আক্রমণ করছে, এমন ভিডিও পাওয়াই তাঁদের লক্ষ্য থাকে।
প্রাণ ও ফসল হুমকির মুখে
শুধু বালিজুড়ি নয়, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী উপজেলা ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলাতেও হাতিকে উত্ত্যক্ত করে ভিডিও তৈরির ঘটনা ঘটছে।
এখন আমন ধানের মৌসুম। সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় আমন ধান পাকার সময় হয়েছে। দিনের বেলায় বনের ভেতরে অবস্থান করলেও এ সময়ে রাতে ধানখেতে হাতির পাল চলে আসে। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা হাতিকে উত্ত্যক্ত করায় এখন দিনের বেলায়ও বেরিয়ে আসছে হাতি।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ এই তিন জেলায় ৩২টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। আর একই সময়ে এসব জেলায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ জন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউ পাওয়ার আশায় যেকোনো মূল্যে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা হাতিকে ক্ষিপ্ত করে তোলেন। হাতি মানুষের পেছনে ছুটছে, বাড়িঘরে আক্রমণ করছে, এমন ফুটেজ পাওয়াই তাঁদের লক্ষ্য থাকে। কাঞ্চন মারাক, স্থানীয় বাসিন্দা, নালিতাবাড়ী
কাঞ্চন মারাক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালের দিকে অল্প কিছু মানুষ হাতি দেখতে বাইরে থেকে আসত। ২০১৮ সালের দিকে এটা বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের শুরু থেকে এটি মারাত্মক সমস্যায় রূপ নেয়। হাতি দিনের বেলায় সচরাচর বাইরে আসে না। বনের ভেতরে বিশ্রাম নেয়। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা এই সময় হাতিদের ঢিল ছোড়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে উত্ত্যক্ত করে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কনটেন্ট ক্রিয়েটররা বেশি ভিড় করেন শ্রীবরদী উপজেলায়। মূল সড়কের কাছাকাছি যেখানে হাতি বিশ্রাম নেয়, সেখানেই শতাধিক ক্রিয়েটর ভিড় জমান।
আমি দূর থেকে ভিডিও করি, হাতিকে উত্ত্যক্ত করি না। কিন্তু অনেক মানুষ হাতিকে উত্ত্যক্ত করে ভিডিও বানাচ্ছেন। আমি লোকজনকে বুঝিয়েছি, কেউ কথা শোনেন না। সোহাগ মিয়া, কনটেন্ট ক্রিয়েটর
বন বিভাগের চ্যালেঞ্জ
নালিতাবাড়ী থানার এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমে (ইআরটি) কাজ করেন আরফান আলী। লোকালয়ে চলে গেলে সেই হাতিকে তিনি বনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কনটেন্ট ক্রিয়েটররা দল বেঁধে আসেন। হাতিকে উত্ত্যক্ত করেন। এখানে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি আছে। হাতিগুলো বিশ্রামের সুযোগ পায় না।
আরফান আরও বলেন, এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের কর্মীরা বাধা দিলে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাঁদের ওপরই চড়াও হন, হামলা করতে আসেন।
কথা শোনেন না কনটেন্ট ক্রিয়েটররা
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সোহাগ মিয়া হাতি নিয়ে নিয়মিত ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করেন।
সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতি নিয়ে ভালো ভিডিও বানানো যায়। ধান পাকার সময় হাতির বিচরণ বেশি থাকে। বাইরে থেকেও অনেকেই ভিডিও করতে আসেন।
হাতিকে উত্ত্যক্ত করে ভিডিও তৈরির কারণে কৃষকের ফসলের ক্ষতি ও স্থানীয়দের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহাগ বলেন, ‘আমি দূর থেকে ভিডিও করি, হাতিকে উত্ত্যক্ত করি না। কিন্তু অনেক মানুষ হাতিকে উত্ত্যক্ত করে ভিডিও বানাচ্ছে। আমি লোকজনকে বুঝিয়েছি, কেউ কথা শোনে না।’

বন থেকে মানুষ ফেরানো কঠিন
বন বিভাগের শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুড়ি সদর এলাকার বিট অফিসার মাজহারুল হক বলেন, আগে লোকালয় থেকে হাতি বনে ফেরানো চ্যালেঞ্জ ছিল, এখন মানুষকে বন থেকে ফেরানো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। বিকেল হলেই শত শত মানুষ হাতি খুঁজতে বের হন। তাঁরা ঢিল ছুড়ে হাতিকে উত্ত্যক্ত করেন।
স্থানীয় ও পাশের জেলা থেকেও ভিডিও করার জন্য মানুষ আসছেন জানিয়ে মাজহারুল বলেন, ভিডিও করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা করছেন না। শত শত মানুষকে বাধা দিতে গেলে তাঁরা উল্টো তাঁদের ওপর চড়াও হন।
বনবিভাগ মাইকিং করে হাতিকে উত্ত্যক্ত না করার জন্য সচেতনতা তৈরি করছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, জনবল স্বল্পতার কারণে শত শত মানুষ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জামালপুর ও শেরপুর মিলিয়ে চারটি বিট অফিসের প্রতিটিতে মাত্র ছয়জন করে জনবল আছে।
হাতিকে বন থেকে বের করে আনতে অনেকে কুকুর সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। কুকুর লেলিয়ে দিলে হাতি স্বাভাবিকভাবে বিরক্ত হয়। কুকুরকে ধাওয়া দিয়ে লোকালয়ে এসে বাড়িঘরের ক্ষতি করছে হাতি। এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেরপুর অঞ্চলের হাতি নিয়ে ২০১৬ সালে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য এম এ আজিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের মেঘালয়ের সংরক্ষিত বন থেকে নিয়মিত ৭০ থেকে ৮০টি হাতি আসা-যাওয়া করত। ২০০৭ সালে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ হাতি শেরপুরের অংশে আটকে পড়ে।
আগে লোকালয় থেকে হাতি বনে ফেরানো চ্যালেঞ্জ ছিল, এখন মানুষকে বন থেকে ফেরানো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। বিকেল হলেই শত শত মানুষ হাতি খুঁজতে বের হয়। তাঁরা ঢিল ছুড়ে হাতিকে উত্ত্যক্ত করে। মাজহারুল হক, বিট অফিসার, বন বিভাগ
গবেষণায় সীমান্তের ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাঁটাতার পাওয়া গেছে। যেখানে মোট ৪৪টি ফটক পাওয়া গেছে, যেগুলোর প্রস্থ মাত্র ৩ মিটার বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এম এ আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, মেঘালয়ের অংশে ভারতের বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়ায় যে গেটগুলো রাখা হয়েছিল, সেগুলো বন্ধ করে রাখা হয়। এ কারণে মাঝেমধ্যে আন্ডারপাস দিয়ে কিছু হাতি ভারতে চলে যায়।

সম্প্রতি শেরপুর অঞ্চলে গিয়েছিলেন জানিয়ে এম এ আজিজ বলেন, ‘হাতিকে বন থেকে বের করে আনতে অনেকে কুকুর সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। কুকুর লেলিয়ে দিলে হাতি স্বাভাবিকভাবে বিরক্ত হয়। কুকুরকে ধাওয়া দিয়ে লোকালয়ে এসে বাড়িঘরের ক্ষতি করছে হাতি।’
এতে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদেরও ঝুঁকি বাড়ছে উল্লেখ করে এম এ আজিজ আরও বলেন, স্থানীয় লোকজন হাতির আচরণ সম্পর্কে জানেন। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তো জানেন না হাতি কখন কীভাবে আক্রমণ করতে পারে। তাই যেকোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ এই তিন জেলায় ৩২টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। আর একই সময়ে এসব জেলায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ জন। এম এ আজিজ বন বিভাগকে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব উৎপাত বন্ধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বন বিভাগের ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক ও বিজিবির কমান্ডারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একদিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এ উৎপাত বন্ধে শিগগির আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।