বাংলার আকাশ ডেস্কঃ
প্রথম জীবনে স্কুলের শিক্ষকের চাকরিকালে ২৩ লাখ টাকার তহবিল তছরুপের দায়ে চাকরি চলে যায়। এরপর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে পাশের গ্রামের একজন চিকিৎসকের নামে নাম পাল্টে শুরু করেন ভুয়া ডাক্তার হিসেবে প্রতারণা। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানে ধরা পড়ে এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে সে যাত্রাও পার পেয়ে যা। তবে থেমে থাকেননি। এরপর পুলিশের রেশনের মালামাল সরবরাহের ঠিকাদার হিসেবে শুরু করেন নতুন প্রতারণা। একে একে চারজন সহজসরল ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী তার কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে তার হাতে তুলে দেন প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো। এই টাকায় গ্রামের বাড়িতে তিনি নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি সহ নানা সম্পত্তি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বিভিন্নজনের নিকট হতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে পুরোটাই আত্মসাতের পায়তারা টের পেয়ে প্রতারিতরা তার বিরুদ্ধে ফরিদপুরের আদালতে মামলা করেন। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে।
এই প্রতারকের প্রকৃত নাম মো. হাবিবুর রহমান বাবুল। তিনি রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি উপজেলার বাওনারা গ্রামের মো. সোহরাব হোসেনের ছেলে। ২০১৫ সালের একটি স্ট্যাম্পে জালিয়াতি করে ১৯৯৯ সালের তারিখ দেখিয়ে হাবিবুর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নিজের নাম বদলে হয়ে যান ডা. রাকিব হাসান শুভ। নাওপাড়ার পাশের গ্রামে ডা. রাকিব আহসান নামে একজন ডাক্তার ছিলেন। হাবিবুর রহমান চতুরতার মাধ্যমে নাম বদলে সেই ডাক্তারের পরিচয়ে শুরু করেন চিকিৎসার নামে প্রতারণা।
এই প্রতিষ্ঠিত প্রতারকের শিকার হয়ে অবসরজীবনে পাওয়া চাকরির পেনশনের প্রায় ৬৯ লাখ টাকা খুইয়ে আসা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য আবুল কালাম তালুকদার (৫৫) ফরিদপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। প্রতারক হাবিবের বিরুদ্ধে ফরিদপুর ও রাজবাড়ীতে পাঁচটি মামলা হয়েছে। তবে মামলার বাদিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় হয়রানির অভিযোগও পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আবুল কালাম তালুকদার জানান, ২৯ বছর চাকরিজীবন শেষে অবসরগ্রহণের পর একটু লাভের আশায় ওই প্রতারকের হাতে ব্যবসার নামে এই টাকা তুলে দিয়েছিলেন দফায় দফায়। তবে এখন এই প্রতারকের বিরুদ্ধে মামলা করায় উল্টো তাকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
আবুল কালাম তালুকদার জানান, তিনি শহরের আলীপুরের আলাউদ্দিন খান সড়কে বর্তমানে বসবাস করছেন। তার শ্যালক মামুন ওই এলাকায় দোকানদারি করে। তাদের বাড়ির পাশে থাকতেন ডা. রাকিব হাসান শুভ পরিচয়দানকারী এক ব্যক্তি। শ্যালক মামুনের মাধ্যমে ডা. রাকিব হাসান শুভ নামে এক ব্যক্তির পরিচয় পান যিনি নিজেকে একজন চিকিৎসক, বড় ঠিকাদার এবং পুলিশ ও জেলখানার রেশন সাপ্লাইয়ার হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর আশানুরুপ মুনাফার লোভ দেখিয়ে পুলিশের রেশনের মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারি ব্যবসার পার্টনার হতে প্রস্তাব দেন। এভাবে কয়েকবার তার সাথে সাক্ষাতে পর বিশ্বাস করে তিনি ডিটের মাধ্যমে কয়েক দফায় পেনশনের ৬৯ লাখ টাকা তুলে দেন রাকিব হাসানের হাতে। একইভাবে তার শ্যালক মেহেদি হাসান মামুনও তার হাতে ঠিকাদারি পার্টনারশীপ বাবদ ৫০ লাখ টাকা তুলে দেন। আবুল কালাম জানান, প্রথম কয়েক মাস তাকে আশ্বাস অনুযায়ী মুনাফা দেয়ার পর একপর্যায়ে গড়িমসি শুরু করে। পরে খোঁজ নিয়ে ওই প্রতারকের বিস্তারিত জানতে পেরে তিনি বুঝতে পারেন যে, এক মহাপ্রতারকের খপ্পড়ে তিনি তার শেষ সম্বলটুকু খুইয়েছেন।
এদিকে বিজিবির সাবেক সদস্য আবুল কালাম তালুকদার ছাড়াও এই প্রতারকের প্রতারণার শিকার হয়েছেন গীতা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার সাহা ও রঞ্জন সাহা নামে আরো দুই ব্যবসায়ী। ফরিদপুর জেলা পুলিশের রেশনে সরবরাহের জন্য ডাল ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমারের নিকট থেকে বাকিতে মালামাল কিনে বকেয়ার প্রায় ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ না করায় প্রদীপ সাহা ডাল বিক্রি বন্ধ করে দেন। এরপর রঞ্জন সাহা নামে আরেক ব্যবসায়ীর নিকট থেকে তিনি ডাল সংগ্রহ করে সরবরাহ করতে থাকেন। এভাবে রঞ্জন সাহার মিল থেকে ৪০ লাখ টাকার ডাল কিনে টাকা পরিশোধে গড়িমসি করতে থাকেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে কোতয়ালী থানায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন প্রতারিতরা। মামলা নং- ১৯(৭)২২, ৪৮(৭)২২ ও ৯৯(৭)২২। এর মধ্যে আবুল কালামের রুজুকৃত মামলায় প্রতারক এই হাবিব তথা রাকিবের সহযোগী হিসেবে তার ভাই মাহাবুবুর রহমান মুকুল (৪২) ও মিজানুর রহমান বকুল (৪২), স্ত্রী সায়মা খানম শিল্পী ও পিতা সোহরাব হোসেন মোল্যাকে আসামি করা হয়েছে।
ভুয়া সনদে চিকিৎসার অভিযোগ তদন্তকালে বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে তদন্তকমিটির বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনি ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিলে ক্রয়কৃত একটি স্ট্যাম্পে বিকৃত করে ১৮ এপ্রিল ৯৯ বানান। ওই তারিখে তিনি এই এফিডেভিটের যেই পত্রিকার তথ্য উল্লেখ করেছেন ওই পত্রিকায় তার নাম পরিবর্তনের কোন বিজ্ঞাপনও খুঁজে পাওয়া যায়নি । তিনি আবার জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, টিন, ট্রেড লাইসেন্স এবং এনআইডিতে নিজের নামের আগে ডা. পদবি যোগ করে পুরো নাম ডা. রাকিব হাসান শুভ লিখেছেন।
এদিকে, ২০১৩ সালের জুন মাসে জাল সনদ দিয়ে চিকিৎসক সেজে প্রতারণার অভিযোগে ফরিদপুরের এনডিসি এসএম শাহীন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এই হাবিবুর রহমানকে আটকের পর এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। হাবিবুর রহমানের দাবি তিনি ১৯৯৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিয়ালদহে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০১ সালে পাশ করেছেন। তবে ভুয়া সনদে চিকিৎসার অভিযোগ তদন্তকালে বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এক রিপোর্টে জানান যে, তার বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) এর রেজিস্ট্রেশন নেই এবং বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন ব্যতিত কেউ কোথাও চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। এছাড়া ৯৯ সালে কলকাতা যেয়ে ২০০১ সালেই ডাক্তারি পাশের তথ্যটিও সন্দেহমূলক বলে অপর এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
প্রথম জীবনে এই প্রতারক বালিয়াকান্দীর বাওনারা হাই স্কুলের প্রথমে সহকারী শিক্ষক ও পরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখানে স্কুল ফান্ডের ২৩ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
প্রাপ্ত অভিযোগে জানা যায়, প্রতারক হাবিবুর নিজেকে বরগুনা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার পরিচয় দিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মালিকানাধীন সুদাইফ এন্টারপ্রাইজের নাম তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। তিনি কখনো নিজেকে বিএমসিএইচের সহকারী অধ্যাপক, ককনো নিউরো সায়েন্স বিশেষজ্ঞ সহ বিভিন্ন ভুয়া পদপদবির মাধ্যমে জাহির করে তার প্রতারণা চালান।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে আবুল কালাম তালুকদার জানান, ডা. রাকিব হাসান শুভ ওরফে হাবিবুর রহমান বাবুলের প্রতারণার শিকার হয়ে এখন আমি এই শেষ জীবনে পরিবারপরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি আমি। এই টাকাটা তার জীবনের শেষ সম্বল ছিল। আমি এখন নিঃস্ব।
ফরিদপুরের কোতয়ালী থানায় হাবিবুর রহমান বাবুলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাহাবুবুল করীম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এই হাবিবুর রহমান বাবুল ওরফে রাকিব হাসান শুভর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। গত শনিবার তাকে আটক করা হয়েছে। তিনি এখন জেলে আটক রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, হাবিবুর একজন প্রতিষ্ঠিত প্রতারক। অনেকের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি চিকিৎসক না হয়েও ভোটার আইডি কার্ডে নামের আগে ডা. ব্যবহার করেছেন। বিয়েও করেছেন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে।
(আহৃত)