বাংলার আকাশ ডেস্কঃ
এমটিবিএফ’র (মিডটার্ম বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক বা মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র দিচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। যে কোনো প্রকল্প গ্রহণ বা সংশোধনের জন্য এই কাঠামোর আওতায় বরাদ্দ প্রস্তাব করার নিয়ম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এমটিবিএফ সীমা মানা হচ্ছে না। ফলে আর্থিক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা। এতে প্রকল্প সংশোধন ও ব্যয় বৃদ্ধির এটি একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ রকম একটি প্রকল্প হচ্ছে ‘উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন (ইউজিডিপি)’ প্রকল্প। এটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে প্রকল্পটি এমটিবিএফ ব্যয় সীমার মধ্য থেকে বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রত্যয়নপত্র দেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও এমটিবিএফ বরাদ্দের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এ রকম আরও একটি প্রকল্প হচ্ছে ‘মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রোববার বলেন, ভুল বা মিথ্যা তথ্যের এ রকম ঘটনা যদি ঘটে থাকে সেটি অবশ্যই প্রতারণা ও দুর্নীতি। এক্ষেত্রে যারা প্রস্তাব দিচ্ছে সেটি তো অবশ্যই প্রতারণা। আর পরিকল্পনা কমিশন যে শুধু মন্তব্য করে ছেড়ে দিচ্ছে, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এটা প্রতারণাকে সুরক্ষা দেওয়ার শামিল। এক্ষেত্রে উভয়পক্ষই দোষী। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এমটিবিএফ’র অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের চলতি অর্থবছরের প্রকৃত বরাদ্দ উল্লেখ থাকবে। এর সঙ্গে পরবর্তী ৩ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দের প্রাক্কলন দেওয়া হয়। যাতে মন্ত্রণালয়গুলো তাদের ব্যয়ের সীমা মেনে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। এটি জাতীয় সংসদে অনুমোদন পাওয়া একটি নিয়ম। এমটিবিএফ সিলিং অমান্য করা কোনোভাবেই উচিত নয়। এতে একদিকে যেমন আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়, অন্যদিকে তেমনি পরিকল্পনা শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ হিসাবে গণ্য হয়। ফলে আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউজিডিপি) সংশোধনী প্রস্তাবে প্রকল্পটি এমটিবিএফ’র ব্যয় সীমার মধ্য থেকে বাস্তবায়নের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু এ বিভাগের তিন অর্থবছরের এমটিবিএফ বরাদ্দ ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি আছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগের এমটিবিএফ বরাদ্দ হলো ৩৩ হাজার ৮৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু মোট চাহিদা হচ্ছে ৭৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ অর্থবছরে চাহিদা ও বরাদ্দে ঘাটতি আছে ৪০ হাজার ৫৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এমটিবিএফ বরাদ্দ ৩৭ হাজার ২৮৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। চাহিদা হচ্ছে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ফলে চাহিদা ও বরাদ্দের ঘাটতি আছে ৭১ হাজার ৫০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ ৪১ হাজার ১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর চাহিদা ৯৯ হাজার ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি আছে ৫৭ হাজার ৯৯১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ৪৫ হাজার ১১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা, আর চাহিদা হলো ৬৮ হাজার ৯০৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি থাকবে ২৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এ অবস্থায় উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্প (ইউজিডিপি) প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়ছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের প্রধান যুগ্মসচিব আবু মো. মহিউদ্দিন কাদেরীর সঙ্গে। শনিবার তিনি বলেন, এ প্রকল্পটিতে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থ আছে। মোট প্রকল্প ব্যয়ের অধিকাংশ বৈদেশিক ঋণ। সরকারি তহবিলের যে অর্থ ধরা আছে তার অধিকাংশ সরকারি ভ্যাট ও ট্যাক্স খাতের ব্যয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এ রকম প্রত্যয়নপত্র দিতে হয় বলেই হয়তো দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ‘মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’ প্রকল্পটি ৯৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি এমটিবিএফ বরাদ্দ সীমার মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি আছে ২ হাজার ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘাটতি আছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটোয়ারীর সঙ্গে। শনিবার তিনি বলেন, এ দায়িত্বে আমি নতুন এসেছি। তাই সুনির্দিষ্টভাবে মাশরুম চাষ প্রকল্পটি নিয়ে না দেখে বলতে পারব না। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, কৃষি খাত এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এটি। সেক্ষেত্রে আমরা যদি এমটিবিএফ সিলিং ধরে বসে থাকি তাহলে তো হবে না। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিলিং পরিবর্তন হতে পারে। যেমন গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে অন্যান্য অনেক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বেড়ে যায়। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত যাতে না হয় সেজন্য সবাই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এছাড়া সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া এ রকম দুটি প্রকল্প হচ্ছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরেন্দ্র এলাকায় খালে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ সম্প্রসরণ প্রকল্প-দ্বিতীয় পর্যায়। এছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হলেও চাহিদা ও বরাদ্দ ঘাটতির কথা তুলে ধরেছে পরিকল্পনা কমিশন।
(আহৃত)