বাংলার আকাশ ডেস্কঃ
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর নিত্যপণ্যের বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। পরিবহণ ব্যয়ের অজুহাতে হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের পণ্যের দাম। প্রায় প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের মূল্য আগের দিনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে দামের চাপ আরও বাড়ছে। চাপ সামাল দিতে গিয়ে দম বন্ধের জোগাড় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। বাজারে যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবেই নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। এর পেছনের কারিগর হচ্ছে অতিমুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা। এরা জ্বালানি তেলের প্রভাবে যে পরিমাণ দাম বৃদ্ধির কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করছে গ্রাহকের কাছ থেকে। এদেরই এক অংশ হাত করে রেখেছেন বাজার পর্যবেক্ষণে জড়িত অসাধু কর্মকর্তাদের। ফলে খেয়াল খুশি মতো দাম বাড়িয়ে ব্যবসা করছে চক্রটি।
জানা গেছে, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বড় ট্রাকে রাজশাহী থেকে চাল আনতে আগের চেয়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। এই ট্রাকে ১০ টন চাল এলে তাতে আগের চেয়ে এক কেজিতে ৫০ পয়সা বেশি ব্যয় হওয়ার কথা। অথচ মান ভেদে এক কেজি চালের দাম চার টাকা থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কোন হিসাবে এই মূল্যবৃদ্ধি তার ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা ।
জ্বালানির অজুহাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি দাম ৫৫ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। ২৫ টাকা বেড়ে প্রতি ডজন ডিম ১৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ ছাড়া সবজি ও মাছ কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। নতুন করে পেঁয়াজের বাড়তি দাম ভোক্তার কপালে ভাঁজ ফেলছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার খেসারত দিচ্ছে ভোক্তা।
এদিকে বাজারে এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আরও ২০ টাকা বাড়াতে চাচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্য সমন্বয়ের জন্য তারা মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন-এক সপ্তাহের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হবে। পাশাপাশি বাজারে চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রিফাইনারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে দিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তার মধ্যে আরও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এটা স্বাভাবিক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে সব খাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে। আগে নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে একাধিক পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে যে হারে দাম বাড়ার কথা, সে হারে বাড়ানো হয়েছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। বাজার তদারকির মাধ্যমে অতি মুনাফা করতে পণ্যের দাম বেশি বাড়ানো হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। এমনটা হলে অসাধুদের চিহ্নিত করে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এতে বাজারে স্বস্তি ফিরবে।
শনিবার সরেজমিন রাজধানীর নয়াবাজার, কাওরান বাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৪ টাকা, যা সাত দিন আগে ৪৫-৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাজারে প্রতি কেজি পাইজাম চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৭ টাকা, যা সাত দিন আগে ৫২ টাকা ছিল। বিআর ২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকা, যা আগে ৫৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৪ টাকা, যা সাত দিন আগে ৬৮-৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নাজিরশাল মানভেদে প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫-৯০ টাকা, যা সাত দিন আগে ৭০-৮৫ টাকা ছিল। আর পোলাও চালের দাম বেড়েছে সব চেয়ে বেশি। কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। কাওরান বাজারের আল মদিনা রাইস অ্যাজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত দুই সপ্তাহ আগে মিলাররা ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বেশির অজুহাতে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছে। এর মধ্যে আবার জ্বালানি তেলের কারণে পরিবহণ খরচ বেড়েছে। ফলে সব মিলে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।
এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২০০-২১০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৬৫-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা, যা আগে ১২৫ টাকা ছিল। দাম বাড়ার কারণ হিসাবে নয়াবাজারের ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে খামার পর্যায়ে মুরগির রোগবালাই বেড়েছে। মুরগি মারা যাচ্ছে। সঙ্গে ডিম উৎপাদনও কমেছে। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ খরচ বেড়েছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা সাত দিন আগে ৪২ টাকা ছিল। প্রতিকেজি খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা, যা গত সপ্তাহে ৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা সাত দিন আগেও ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ৪০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি চিনি ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৮২ টাকা ছিল। প্রতি কেজি পাকা টমেটো বিক্রি হয়েছে ১১০-১৩০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ৮০-১০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহে ৪০-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া শসা শনিবার বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। পাঁচ টাকা বেড়ে এক কেজি পেঁপে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে চিচিঙ্গা, ধুন্দল, কাঁকরোল বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। প্রতি কেজি বেগুন ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৬০-৬৫ টাকা ছিল। বাজারে প্রতি কেজি রুই মাছ ৩৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৩১০ টাকা ছিল। ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি পাঙ্গাশ ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. নূরে আলম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সব পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি বাজার তদারকি সংশ্লিষ্টদের দেখা উচিত। কারণ আমরা ক্রেতা অনেক কষ্টে আছি। এভাবে যদি পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, পাশাপাশি অন্যান্য ব্যয় বাড়তে থাকে। তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে যাতে অসাধুরা পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। এ জন্য তিন স্তরে তদারকি চলছে। অসঙ্গতি পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
হাকিমপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের পাইকারি ও খুচরা বাজারে বেড়েছে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম। দু’দিনের ব্যবধানে ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিতে আট টাকা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। শনিবার দুপুরে হিলি বাজার ঘুরে এ তথ্য পাওয়া যায়।
রংপুর ব্যুরো জানায়, রংপুর জেলাসহ বিভাগের আট জেলায় চালের বাজার আবারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে চার টাকা থেকে ছয় টাকা। ফলে চালের বাজার সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রংপুর নগরীসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় প্রায় ২০০ অটোরাইস মিল আছে। এসব মিলের কিছু অসাধু মালিক বিদ্যুতের সমস্যাকে পুঁজি করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালের মজুত গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। গত এক সপ্তাহ আগে মিনিকেট চালের (৫০ কেজি) বস্তা ছিল তিন হাজার টাকা, সেই চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকায়, ব্রিধান-২৮ (৮৪ কেজি) বস্তা ছিল তিন হাজার টাকা, বর্তমানে তিন হাজার ৫৫০ টাকা।
আহৃত