জ্বালানি তেলের কারণে দূরপাল্লার রুটগুলোতে বাসভাড়া যাত্রীপ্রতি এক লাফে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। নতুন ভাড়া কার্যকর করায় সাধারণ যাত্রীদের মাথায় চাপল বাড়তি খরচের বোঝা।
ঢাকা থেকে খুলনার ২৭২ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে একজন যাত্রীর ৬৯১ টাকা বাস ভাড়া লাগত। সরকারি হিসাবেই রোববার তা দাঁড়িয়েছে ৮৮৬ টাকায়। যাত্রীপ্রতি খরচ বেড়ে গেছে ১৯৫ টাকা।
চার সদস্যের পরিবার খুলনা ভ্রমণে শুধু যাতায়াত ব্যয় বাড়ছে ৯৮০ টাকা। শুধু খুলনা নয়, দেশের ৪৫০ রুটে দূরত্ব অনুযায়ী যাতায়াত খরচ বেড়েছে। একইভাবে ব্যয় বেড়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বসবাসকারী কর্মজীবী মানুষেরও।
রাজধানীতে রুটভেদে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। অফিসগামীদের নিত্যদিনই এই বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিক্ষুব্ধ একাধিক যাত্রী।
যাত্রীরা অভিযোগ করেন, রাজধানীতে তাদের জিম্মি করে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করেছে গণপরিবহনের শ্রমিকরা। অন্যদিকে বিআরটিএ বলছে, ভাড়া নৈরাজ্য যাতে না হয়, সেজন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেটদের ৭টি টিম মাঠে রয়েছে।
শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসে ১৬.২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ভাড়া বৃদ্ধির এ হার যাত্রী স্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা নতুন ভাড়ার হার নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় না করতে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের অনুরোধ জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নতুন ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
বাস ভাড়া বাড়ানো হলেও যাত্রী হারানোর আতঙ্কে আছেন মালিকরা। তারা বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় গণপরিবহণে যাতায়াতও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট সোহাগ পরিবহণের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, বাসের নতুন ভাড়া যাত্রীদের জন্য তো বটেই, মালিকদের জন্যও খারাপ হয়েছে।
যাতায়াত খরচ বেড়ে যাওয়ায় কমে যাবে যাত্রী সংখ্যা। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হবে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া কমবে।
তিনি বলেন, গাড়ির যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানি খরচ বেড়েছে। বাড়তি খরচের ওপর শুল্কও দিতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে পরিবহণ পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়েছে।
জানা গেছে, নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর শনিবার দূরপাল্লার রুটে বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যাত্রীপ্রতি এক কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৪০ পয়সা।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাসে ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাস উভয়ের ভাড়া ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে। জানা গেছে, নতুন ভাড়া নিয়ে বিআরটিএ তালিকা তৈরি করেছে।
যদিও রোববার পর্যন্ত ওই তালিকা বাসে বা কাউন্টারগুলোতে দেখা যায়নি। নতুন তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত (পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে) ২৪২ কিলোমিটারের ভাড়া হয়েছে ৭৫০ টাকা, আগে যা ছিল ৬২৬ টাকা।
এ পথের ভাড়া বেড়েছে জনপ্রতি ১২৪ টাকা। রংপুর পর্যন্ত ৩০৮ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া ৬০১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৯৮ টাকা; যা আগের চেয়ে ১৫৭ টাকা বেশি। ঢাকা-বগুড়া ৪৭৩ টাকার ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৫৭০ টাকা।
ঢাকা থেকে পাবনা ২২৩ কিলোমিটারের বাস ভাড়া ৫৪৬ টাকা থেকে ৬৬০ টাকা হয়েছে। রাজশাহীর ভাড়া ৬০১ টাকা থেকে ৭২৭ টাকা ও দিনাজপুরের ভাড়া ৭৯৩ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬১ টাকা হয়েছে।
একইভাবে মিরপুরের কালসী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া দাঁড়িয়েছে ৪৮ টাকা, যা আগে ছিল ৪০ টাকা। ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত ৯ কিলোমিটারের নতুন ভাড়া হয়েছে ২২ টাকা ৫০ পয়সা; যা আগে ছিল ১৯ টাকা ৩৫ পয়সা।
সদরঘাট থেকে মালিবাগ হয়ে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ২২ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরত্বের নতুন ভাড়া হয়েছে ৫৫ টাকা; যা আগে ছিল ৪৮ টাকা। যদিও ওয়েবিলের নামে সরকারি নির্ধারিত ওই হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে আসছে পরিবহণ শ্রমিকরা। একইভাবে অন্যান্য রুটেও ভাড়া বেড়েছে।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মো. রাসেল জানান, চাকরির কারণে প্রতিদিনই তাকে সচিবালয়ে যাতায়াত করতে হয়। তিনি বলেন, আগেও বাসে সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া নিত।
এখন আরও বাড়ল। বেশি ভাড়া দেওয়ার পরও মানসম্মত বাস নেই। বাসে উঠলে বসার জায়গাও অনেক সময়ে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, যেভাবে সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তার ওপর বাস ভাড়া বৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
অনেক যাত্রী অভিযোগ করেন, গণপরিবহণে নতুন বর্ধিত ভাড়া না মেনে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি আদায় করা হয়েছে। ওদিকে চালক ও হেলপাররা বলছেন, তারা এখনও ভাড়ার চার্ট হাতে পাননি। এ কারণে অনুমান করে ভাড়া আদায় করছেন।
শাহবাগে কথা হয় বাসযাত্রী আলমগীর ও স্বপন হাওলাদারের সঙ্গে। তারা বলেন, নতুন বর্ধিত ভাড়ায়ও সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা রাখা হয়েছে। অথচ ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মিরপুর ও গাবতলী রোডের বাসগুলো আদায় করছে ১৫ থেকে ২০ টাকা ভাড়া।
তিনি বলেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পরিবার নিয়ে বাঁচা দায়। হুমায়ুন মৃধা নামের এক যাত্রী বলেন, শেওড়াপাড়া থেকে শাহবাগ যাচ্ছিলেন শিকড় পরিবহণের একটি বাসে।
ওই বাস তার কাছ থেকে ৪০ টাকা ভাড়া নেয়। অথচ শেওড়াপাড়া থেকে তার গন্তব্যস্থলের দূরত্ব সাড়ে ৯ কিলোমিটারেরও কম। সরকার নির্ধারিত ভাড়া কাটলে ২৪ টাকারও কম নিতে হয়।
তিনি বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে যাত্রীদের বাগবিতণ্ডা চলছিল। আগারগাঁও থেকে একজন ওই বাসে উঠেন। তিনি সুপারভাইজারের পক্ষ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু করেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে
আহৃত