শিল্পকারখানাতেও লোডশেডিং করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ রেশনিং যথাযথভাবে হচ্ছে না। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকলেও এরপর বিভিন্ন সময়ে থাকছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।
এ পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআই ভবনে ‘এনার্জি সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্ট অব দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ব্যবসায়ী নেতারা একথা বলেন।
তারা সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে কয়লাভিত্তিক জ্বালানিতে যাওয়ার সুপারিশ করেন। বাপেক্সকে (বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান) আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান; বলেন, সমুদ্রে যে গ্যাস আছে সেটিও উত্তোলন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি সরকারের কাছে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি চান। জসিম উদ্দিন বলেন, পরিবেশ ধ্বংস না করেও উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি উৎপাদন করা যেতে পারে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কয়লা বিদ্যুৎ থেকে জ্বালানির একটা বিরাট অংশের চাহিদা মেটাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো উৎপাদিত গ্যাসের ৩০ শতাংশ পূরণ করলেও ৭০ শতাংশ গ্যাস পাওয়ার কথা বাপেক্স থেকে। কিন্তু আমরা তার উলটাটা পাচ্ছি। বিদেশি কোম্পানিগুলো দিচ্ছে ৬০ শতাংশের বেশি আর বাপেক্স দিচ্ছে ৩০ শতাংশ। এই পার্থক্য কমিয়ে আনা দরকার এবং লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ রেশনিং করা দরকার।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, কৃষি ও শিল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েই সরকার বিদ্যুৎ রেশনিং করছে। এতে সাময়িক অসুবিধা হলেও দেশের স্বার্থেই তা মেনে নেওয়া প্রয়োজন। জ্বালানি ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, মানুষের মতো গ্যাসক্ষেত্রেরও একটা আয়ুষ্কাল রয়েছে।
সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় বিদ্যুতের পরিমাণ মোট ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিশাল অঙ্কের একটা মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে। এরা বাংলাদেশের পেটে লাথি দিয়ে যাচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস লোডশেডিং প্রসঙ্গে বলেন, শত সমস্যার মধ্যেও সরকার কারখানা চালু রাখার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। সরকারের পলিসি হলো ডোমেস্টিক (বাসাবাড়িতে) সেক্টরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে শিল্পে বাড়িয়ে দেওয়া।
শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া। শুধু তেল-গ্যাস নয়, বর্তমানে কয়লাও ব্যয়বহুল। বর্তমানে কিছু কিছু কারখানা আবাসিক এলাকায় হওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। সেজন্য হয়তো আপনারা সাফার (কষ্ট) করছেন। আমাদের জানালে আমরা সমন্বয় করার চেষ্টা করব।
টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট বিদ্যুৎ কনজাম্পশন হয়েছে ৭১ হাজার ৪৭১ মিলিয়ন কিলোওয়াট।
এর মধ্যে শিল্পকারখানায় ২৮.৪০ শতাংশ, কৃষিতে ২.৪৩ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ১০.৫৮ শতাংশ, বাসাবাড়িতে ৫৬.৫৪ শতাংশ ও অন্যান্যতে ২.১৬ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে। তিতাসের উৎপাদিত গ্যাসের ৮-৯ শতাংশ চুরি হয়ে যায়। এ ছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দামে এলপিজি গ্যাস বিক্রি হয় বাংলাদেশে।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্র এক্সপ্লোরেশনের (আবিষ্কার) ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশ ৩টি কূপ খনন করলে ১টি গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়ে যায়। আর আমেরিকা ও ভারতের মতো দেশ ৫টি বা ১০টি কূপ খনন করলে মাত্র ১টি গ্যাসের সন্ধান পায়।
মুক্ত আলোচনায় ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, বিদ্যুৎ রেশনিং যথাযথভাবে হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ যথাযথ না হলে শিল্পে যে লক্ষ্য আছে, দেশের যে লক্ষ্য আছে-কর্মসংস্থান সৃষ্টির, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার তা ব্যাহত হবে। শিল্পায়ন ব্যাহত হবে। ফরেন কারেন্সির যে প্রয়োজন, রপ্তানি কমে গেলে সে চাপ আরও বাড়বে।
আমাদের একটি ইমার্জেন্সি ফান্ড দরকার। আমাদের এনার্জি কেনার জন্য অনেক সময় ডলার থাকে না। আমরা বলি এনার্জি সিকিউরিটি বন্ড। বন্ডের ব্যবহার সারা পৃথিবীতে আছে।
সাত হাজার কোটি টাকার একটি বন্ড থাকলে, সেটা ডলারে রূপান্তর করে রাখলে জ্বালানি সংকটে তা জরুরিভিত্তিতে ব্যবহার করা যাবে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা জানান, বাংলাদেশে যে পরিমাণ কয়লা রয়েছে তা দিয়ে আগামী ৭০ বছর পার করা সম্ভব। এটা জ্বালানির একটা দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা। অনেকেই (পোশাক শিল্প, ইটকল, সিরামিকস) অভিযোগ করেন, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, ব্যাংকগুলো এলডিসি দিচ্ছে না, উৎপাদন অসম্পন্ন থাকায় পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা এই সময় শিল্প খাতকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান তারা। অনুরোধ করেন, বিদ্যুৎ নিয়ে যেন কোনো ধরনের রাজনীতি না করা হয়।
আহৃত