‘এখনও রক্তের রঙ ভোরের আকাশে। পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে, কবে থেকে ভাসছে বাতাসে। অপেক্ষায়- শব্দের- শব্দেই হবে সে মুখর- আরো একবার, জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার, পাখায় পড়বে এসে, ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে। মানুষ তো ভয় পায় বাকহীন মৃত্যুকেই, তাই ওঠে নড়ে, থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার ‘পনেরো আগস্ট’ কবিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এভাবেই লিখেছেন। একজন মানুষ মৃত্যুর পরেও কতটা শক্তিশালী, একটা জাতির কতটা জুড়ে থাকতে পারে, তার উদাহরণ বঙ্গবন্ধু।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে নরপিশাচরূপী ঘাতকচক্র। যে আজীবন সংগ্রাম আর ত্যাগে আমাদের এনে দিয়েছিলেন মহান স্বাধীনতা। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীন সেই দেশেই হায়েনার দল কেড়ে নিয়েছিল সেই পিতার প্রাণ। এরপর থেকে এই মাসটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর শোকের মাস হিসাবে পরিচিত। বেদনা আর শোকের দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে আবারও হাজির হয়েছে সেই শোকাবহ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারানো বেদনাবিধুর এই মাসের প্রথম দিন আজ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা। শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি এই আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করেন। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তার পেছনে ছিল গভীর অধ্যয়ন, জানা-চেনা-শোনা ও দেখার গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তিনি হৃদয়ের আবেগকে যথেষ্টভাবে ধারণ করতে সমর্থ হন। এর পেছনে ছিল মানুষকে ভালোবাসা ও সাহায্য করার জন্য তার দরদি মন। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ যে বাঙালির জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, কখনো ভাবেননি সেই বাঙালিই (কতিপয় দিগ্ভ্রান্ত) তার জীবনের হুমকি হতে পারে। এ কারণে বাড়তি নিরাপত্তার ধার ধারেননি তিনি। সুরক্ষিত রাষ্ট্রপতির বাসভবন ছেড়ে বসবাস করতেন প্রিয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। কিন্তু রাতের আঁধারে ৩২ নম্বর বাড়িতে পৈশাচিক পন্থায় হামলা চালান দিগ্ভ্রান্ত খুনিরা। বুলেটের আঘাতে রক্তগঙ্গা বয়ে যায় পুরো বাড়ি। ঝাঁজরা হয়ে যায় দরজা, জানালা, বাড়ি ও দেওয়াল। রক্তসাগরে ডুবে ছিল লাশগুলো।
সেদিন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগিনীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহিদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নৃশংসভাবে নিহত হন।
ঘাতকের দল তার সেই প্রিয় বাঙালিদের কাছ থেকে, স্বপ্নের স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শরীরী মুজিবকে হত্যা করলেও বাঙালির হৃদয় থেকে প্রিয় পিতাকে মুছে ফেলতে পারেনি তারা। তাই আজও শ্রাবণের বৃষ্টি, সবুজ মাঠের সীমনা, নদীর পাড় ঘেঁষে সমুদ্রের জল, গাছের পাতারাও শোকে ঝরছে অবিরল। বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। মুজিবাদর্শে শানিত বাংলার আকাশ-বাতাস, জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবহমান থাকবে। তাহ তো আজও আগস্ট এলেই এই বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তার পিতাকে।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু ঘাতকরা তার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ১৫ আগস্ট শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, হত্যার বিচার বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি আইন জারি করেছিল। ঘাতকরা চেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ হোক। বাংলাদেশ একটি ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ হিসাবে পরিচিত লাভ করুক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সব চক্রান্ত, সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে; বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাও বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে থাকেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।
এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও আগস্ট মাসকে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগসহ পুরো জাতি পালন করে শোকের মাস হিসাবে। ১ আগস্টের প্রথম প্রহর থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, শোক ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে।
আহৃত