মুদ্রাবাজারের অস্থিরতায় ডলারের তেজ বাড়ছে। কিন্তু বাজারের দখল হারাচ্ছে ডলার। টাকার বিপরীতে যেমন ডলারের দাম বাড়ছে, তেমনি ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন হচ্ছে। তবে পাউন্ড এখনো তার আগের অবস্থান কিছুটা ধরে রেখেছে। ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার দামও কমছে।
সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রা যুদ্ধে ডলার আপাতত শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এদিকে ইউরোর দাম কমায় বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আসা কমে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ রপ্তানিকারকরা এখন এর বিকল্প খুঁজছে।
এদিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। ফলে রাশিয়ার মুদ্রায় অন্য কোনো দেশ পণ্য আমদানি–রপ্তানি করতে পারছে না। এ অবস্থা মোকাবিলা করতে রাশিয়া তার মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
তারা রাশিয়ান মুদ্রাসহ নিজ নিজ দেশের মধ্যকার বিকল্প লেনদেন পদ্ধতি চালু করছে। ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে চীন, ভারত, ইরানসহ আরও কিছু দেশ মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা চালু করেছে। এর আওতায় তারা আমদানি–রপ্তানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ডলার বাজারের দখল হারাচ্ছে। আগে ওইসব দেশও ডলারে পণ্য আমদানি–রপ্তানি করত।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মুদ্রা যুদ্ধে এখন ডলার বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে রাশিয়ার নেতৃত্বে চীন ও অন্য দেশগুলো মিলে যদি বিকল্প কোনো লেনদেন পদ্ধতি তৈরি করে ফেলে তখন ডলার তার একক আধিপত্য হারাবে। ফলে এখন খুব সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থার দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নজর দিতে হবে।
সূত্র জানায়, এক বছর আগে প্রতি ইউরোর দাম ছিল ১০৪ টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকায়। কমেছে ১০ টাকা। এক বছর আগে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকা। বেড়েছে ৮ টাকা। পাউন্ডের দাম এক বছর আগে ছিল ১১৮ টাকা।
এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১১৩ টাকা ৫০ পয়সায়। কমেছে প্রায় ৫ টাকা। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশই ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সের ৩৪ শতাংশ ওই অঞ্চল থেকে আসছে। আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দাম বাড়ায় যারা আমেরিকায় রপ্তানি করেন এবং আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স পাঠান তারা লাভবান হচ্ছেন।
তবে আমেরিকা থেকে যারা আমদানি করেন তাদের দাম বেশি পড়ছে। এছাড়া ডলার ব্যবহার করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দাম বেশি পড়ছে। একই সঙ্গে ডলার ব্যবহার করে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু রেমিট্যান্স যে দেশ থেকে পাঠানো হয় ওই দেশের মুদ্রায় ব্যাংকে জমা করে পরে তা ডলারে বা অন্য কোনো মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারের ওপর নির্ভর করে এক্ষেত্রে লাভবান বা লোকসানে পড়ার বিষয়টি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। সৌদি মুদ্রার রিয়ালের সঙ্গে ডলারের দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি।
যে কারণে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্সে পাঠানোর ক্ষেত্রে ওই দেশে কোনো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ওই রেমিট্যান্সে যখন ডলারে রূপান্তর হচ্ছে তখন বাংলাদেশে এসে বাড়তি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। কেননা টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে।
ইউরোপ থেকে রেমিট্যান্স পাঠালে ও রপ্তানি আয় আসলে সেগুলোর বিপরীতে দাম কম পাওয়া যাবে। কেননা ইউরোপের একক মদ্রা ইউরোর বিপরীতে টাকা যেমন শক্তিশালী হয়েছে, তেমনি ডলারও।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ইউরোর দাম টাকা ও ডলারে দুই মুদ্রায়ই কমেছে। ফলে ইউরোপে পণ্য রপ্তানিতে আয় কমে যাবে। একই সঙ্গে ওই দেশে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ইউরোপের দেশগুলোও পণ্য আমদানি কমিয়ে দিতে পারে।
এ সংকট মোকাবিলার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে আলোচনা করা দরকার। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংকটটি বৈশ্বিক। এতে দেশের কোনো হাত নেই। যে কারণে এখন খুব সতর্কের সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডের বিপরীতে টাকার মান বাড়ার কারণে ওই দেশ থেকেও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আসার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কমবে। ভারতীয় মুদ্রা রুপির বিপরীতে ডলার যে হারে বেড়েছে তার চেয়ে কম বেড়েছে টাকার বিপরীতে। ফলে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
কেননা চীনের মুদ্রা ইউয়ানের দাম ডলারের বিপরীতে যে হারে কমেছে টাকার দাম তার চেয়ে কম কমেছে। ফলে চীন থেকে আমদানিতেও বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। দেশের মোট আমদানির ৭০ শতাংশ ওই দুটি দেশ থেকে করা হয়।
অন্যান্য দেশের মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের মুদ্রার দাম বেশি কমেছে ডলারের বিপরীতে। শ্রীলংকার মুদ্রার মান কমেছে ৪৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানের মুদ্রার মান কমেছে ২৩ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে স্থিতিশীল রয়েছে। ফলে ওইসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মুদ্রার মানের দিত থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বরং বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়ায় তারা বেশি অর্থ পাচ্ছে।
(আহৃত)