হঠাৎ রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসায় কিছুটা উদ্বেগ এবং শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও এ শঙ্কা খুবই প্রাথমিক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবুও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। কারণ এটা একটা সতর্কবার্তা। তাদের মতে, ভয় না হলেও অভয়ে থাকারও সুযোগ নেই। রিজার্ভ বাড়াতে সুদ ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে উদ্ভ‚ত সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারও নেই। প্রকৃত রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। অথচ এটা কিছু দিন আগেও ছিল আট মাসের।
তিনি বলেন, রফতানি উন্নয়ন ফান্ডে (ইডিএফ) যা বিনিয়োগ করা হয়েছে তা কেন রিজার্ভ হিসাবে ধরব? এছাড়া শ্রীলংকাকে যা দেওয়া হয়েছে তা আর ফেরত আসার আশা নেই। সব মিলিয়ে রিজার্ভের বর্তমান অঙ্ক কোনো অবস্থায় সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। আর নীতি সহায়তা যা আছে তাও এই সংকট উত্তরণে কাজ করছে না। যদি উত্তরণ চায় তবে অবশ্যই সুদ ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আমদানির ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। কিছুতেই বিলাসি পণ্য আমদানি করা যাবে না। তা না হলে রিজার্ভ সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (আকু) আমদানির অর্থ পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে এসেছে। এদিকে আমদানির অর্থ ব্যাংকগুলো নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে, এর দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে বিল পরিশোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ গত সপ্তাহে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি দায় শোধ করেছে।
ফলে প্রায় দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর বুধবার তা আরও কমে ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের অংক ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন আঞ্চলিক লেনদেনের জন্য আমদানি লেনদেন নিষ্পত্তি করে থাকে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা আকুর সদস্য। ইরানের রাজধানী তেহরানে এর সদর দপ্তর। এই ব্যবস্থায় দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে হয়। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুতে চাপ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এখনই অনেক বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আকু বিল পেমেন্টের পর কিছুটা কমে এসেছে। তবুও আগাম সতর্কতার অংশ হিসাবে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় বন্ধ করতে হবে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে অন্য খাতে টাকা ব্যবহার করা যাবে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের নিচে যাওয়া একটা সতর্কবার্তা। যদিও এখানে একক কারও দায় নেই। করোনাপরবর্তী আমদানির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সার্বিক কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে দেশের বাজারে চলছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। মনে রাখতে হবে হুকুম দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এতে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি হবে। সেজন্য স্বাধীন বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। আংশিক বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে। তা যেন কোনো অবস্থায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না হয়। অর্থনীতিকে যতটা বাজারভিত্তিক করা যায় ততটা মঙ্গল। তিনি বলেন, আমদানি ব্যয় কমাতে ইতোমধ্যে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব কিছুদিন পর দেখতে পাব। তার আগে বৈদেশিক বাজেট সহায়তা এলে রিজার্ভ কিছুটা বাড়বে। তখন শঙ্কাও কেটে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার যোগদান করে মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, যেন ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। আমদানি ব্যয়ের চাপও অনেক। তাই রিজার্ভে কিছুটা টান পড়েছে। তবে এটা সাময়িক, দ্রুত কেটে যাবে।
আহৃত